বিশ্বব্যাপী পুনর্ব্যবহারযোগ্য শক্তির উৎস হিসেবে সমুদ্রের তাপমাত্রা ব্যবধানকে ব্যবহার করার জন্য দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করা হচ্ছে। ওশান থার্মাল এনার্জি কনভারশন (OTEC) এর মাধ্যমে সমুদ্রের গরম ও ঠান্ডা পানির তাপমাত্রার পার্থক্যকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হচ্ছে, যা অনেক দেশে ইতোমধ্যেই পরীক্ষামূলক ভাবে শুরু হয়েছে। এই প্রযুক্তিটি বিশেষ করে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর জন্য পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই শক্তির উৎস হিসেবে বেশ উপযোগী বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
OTEC প্রযুক্তির কার্যপ্রণালীতে গরম পৃষ্ঠের পানি এবং গভীর সমুদ্রের ঠান্ডা পানির তাপমাত্রা ব্যবধান ব্যবহার করা হয়। এতে পৃষ্ঠের গরম পানি একটি বাষ্পীভবন যন্ত্রের মাধ্যমে বাষ্পে পরিণত হয় এবং এই বাষ্প একটি টারবাইনকে চালিত করে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। পরে এই বাষ্প ঠান্ডা পানির মাধ্যমে আবার তরলে পরিণত হয় এবং পুনরায় সঞ্চালিত হয়। বিশেষ করে উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে এই প্রযুক্তি খুব ভালো কাজ করে, যেখানে পৃষ্ঠের পানি বেশি গরম এবং গভীর সমুদ্রের পানি খুব ঠান্ডা। এছাড়া, সমুদ্রের পানি ব্যবহার করে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে পানিও শোধিত করা সম্ভব, যা উপকূলীয় ও দ্বীপ অঞ্চলে মিঠা পানির চাহিদা পূরণে সহায়ক।
বর্তমানে ওটিইসি প্রযুক্তি উন্নত করার জন্য ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জ এবং মরিশাসে বড় মাপের প্রকল্প চলছে। ক্যানারি দ্বীপপুঞ্জে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অর্থায়নে প্লোটেক প্রকল্পের অধীনে একটি ঝড়প্রতিরোধী ওটিইসি মডেল তৈরি করা হয়েছে, যা শীঘ্রই আটলান্টিক মহাসাগরে পরীক্ষার জন্য স্থাপন করা হবে। এটি প্রাথমিকভাবে ৩ কিলোমিটার দূরত্বে সাগরের মধ্যে স্থাপিত হবে এবং এর মাধ্যমে ঝড়বৃষ্টির সময়েও ওটিইসি প্রযুক্তির স্থায়িত্ব এবং কার্যকারিতা যাচাই করা হবে।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে চীন
অন্যদিকে, মরিশাসে ওটিইসি প্রযুক্তি স্থানীয়ভাবে শক্তি উৎপাদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাপানের অর্থনীতি, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয় (METI) দ্বারা অর্থায়িত একটি গবেষণা প্রকল্পের মাধ্যমে মরিশাসে গভীর সমুদ্রের পানি সংগ্রহের জন্য পাইপ বসানোর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হচ্ছে। এই প্রকল্পটি শুধু মরিশাসের জন্যই নয়, বরং অন্যান্য দ্বীপ অঞ্চলে পরিবেশবান্ধব শক্তি উৎপাদনে অবদান রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার প্রয়োজনীয়তা এবং টেকসই শক্তির চাহিদা বাড়ার কারণে OTEC প্রযুক্তির গুরুত্ব বাড়ছে। বিশেষ করে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঝুঁকিতে থাকে এবং তাদের নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। OTEC প্রযুক্তি তাদের জন্য একটি কার্যকর সমাধান হতে পারে কারণ এটি পরিবেশবান্ধব, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে সক্ষম এবং প্রাকৃতিক ঝড়ঝঞ্ঝা সহ্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে। এই প্রযুক্তি দ্বীপ রাষ্ট্রগুলোর সাথে সাথে উপকূলীয় এলাকায়ও শক্তির চাহিদা মেটাতে সহায়ক হতে পারে।
বিশ্বজুড়ে ওটিইসি প্রযুক্তির প্রসার ঘটাতে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো এই প্রকল্পের ব্যয় এবং নির্মাণাধীন কাঠামোসমূহের ওপর সাগরের প্রভাব। বিশেষ করে ঢেউ এবং সমুদ্রের তীব্র স্রোত OTEC প্রকল্পের স্থাপনা গুলোর ক্ষতি করতে পারে। তবুও, গবেষকরা এই প্রযুক্তির সাশ্রয়ী এবং কার্যকর সংস্করণ তৈরির জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতে, প্রযুক্তির উন্নতির সাথে সাথে ওটিইসি প্রকল্পগুলো আরও শক্তিশালী হবে এবং স্থিতিশীল শক্তি উৎপাদনে আরো বড় ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হাওয়াইতে প্রথম ওটিইসি প্রকল্প শুরু হয়েছিল ১৯৭৪ সালে। বর্তমানে সেখানে প্রাকৃতিক শক্তি গবেষণাগারটি একটি ১০৫ কিলোওয়াট ক্ষমতার ওটিইসি প্রকল্প চালু রেখেছে, যা স্থানীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সরবরাহ করছে। এই প্রকল্পটি আরও বড় মাপে ওটিইসি প্রযুক্তি বাস্তবায়নের পথে একটি মাইলফলক স্থাপন করেছে। এর পাশাপাশি, যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীও এই প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করেছে, যাতে ভবিষ্যতে বৃহত্তর আকারে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়।
OTEC প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়ে গবেষণা ও উন্নয়ন এখনও চলমান রয়েছে। বিভিন্ন দেশ এবং অঞ্চলে এই প্রযুক্তির প্রয়োগ বাড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। বিশেষ করে, বিশ্বব্যাপী দ্বীপ রাষ্ট্র এবং উপকূলীয় অঞ্চলগুলো টেকসই শক্তির উৎস হিসেবে ওটিইসি প্রযুক্তির সম্ভাবনা দেখছে। বর্তমান OTEC প্রকল্পগুলো শুধু শক্তি উৎপাদনেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং পরিবেশবান্ধব পানীয় জলের সরবরাহেও সাহায্য করতে পারে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে এই প্রযুক্তিতে আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এর উন্নয়নে নতুন নতুন গবেষণা পরিচালিত হচ্ছে। আগামীতে OTEC প্রযুক্তি আরো উন্নত এবং কার্যকর হতে পারে। এছাড়া, এটি একটি বৈশ্বিক প্রচেষ্টায় অবদান রাখবে যেখানে টেকসই শক্তির মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কমানো সম্ভব হবে।
ওজনহীন ব্যাটারি প্রযুক্তি উদ্ভাবন যা ইলেকট্রিক যানবাহনের রেঞ্জ বাড়াবে ৭০% পর্যন্ত