গুগল সম্প্রতি তাদের নতুন কোয়ান্টাম চিপ “উইলো” উন্মোচন করেছে, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই চিপটি এত দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য যে এটি বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি জগতে নতুন আলোচনার সৃষ্টি করেছে। তবে সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো গুগলের কোয়ান্টাম এআই প্রতিষ্ঠাতা হার্টমুট নেভেনের একটি সাহসী দাবি। তার মতে, এই চিপের অবিশ্বাস্য পারফরম্যান্স এমন ইঙ্গিত দেয় যে এটি অন্য মহাবিশ্বের কম্পিউটেশনাল শক্তি ব্যবহার করছে। এর ফলে, এটি একাধিক মহাবিশ্ব বা মাল্টিভার্স এর অস্তিত্বকে সমর্থন করে।
নেভেন তার ব্লগ পোস্টে উল্লেখ করেছেন যে উইলো চিপটি এমন একটি গণনা মাত্র পাঁচ মিনিটে সম্পন্ন করেছে, যা বর্তমানের সবচেয়ে শক্তিশালী সুপারকম্পিউটার ১০২৫ বা ১০ সেপটিলিয়ন বছর সময়ে করতে পারে। এই সময়কাল আমাদের মহাবিশ্বের বয়সকেও ছাড়িয়ে যায়। এই তথ্য বিজ্ঞানী ডেভিড ডয়েচের তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ, যিনি প্রথম মাল্টিভার্স ধারণার কথা বলেছিলেন। নেভেন বলেছেন, এই চিপের কাজ করার পদ্ধতি থেকে বোঝা যায় যে কোয়ান্টাম কম্পিউটেশন একাধিক সমান্তরাল মহাবিশ্বে সংঘটিত হতে পারে।
এই দাবিটি প্রযুক্তি জগতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। কিছু বিশেষজ্ঞ নেভেনের এই তত্ত্বকে যথেষ্ট ভিত্তিহীন মনে করেন, কারণ গুগল নিজস্ব মানদণ্ড ব্যবহার করে চিপের পারফরম্যান্স পরিমাপ করেছে। তাদের মতে, এটি প্রমাণ করে না যে সমান্তরাল মহাবিশ্বে আমাদের অন্য রূপ বিদ্যমান। তবে অন্য অনেক বিশেষজ্ঞ এবং বিজ্ঞানী মনে করেন যে নেভেনের দাবি সম্ভবত বাস্তবতার কাছাকাছি। কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিরাও মাল্টিভার্সের ধারণাকে গুরুত্ব সহকারে গবেষণা করেছেন।
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল পার্থক্য হলো এটি ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের মতো ০ বা ১ (চালু বা বন্ধ) বিটের উপর ভিত্তি করে কাজ করে না। বরং, এটি কাজ করে কোয়ান্টাম বিট বা কিউবিট ব্যবহার করে। কিউবিট একসাথে ০, ১, অথবা উভয় অবস্থানে থাকতে পারে। এর মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটার অসংখ্য জটিল সমস্যা সমাধান করতে পারে, যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার দিয়ে সম্ভব নয়। এছাড়া কিউবিট কোয়ান্টাম এনট্যাংলমেন্ট ব্যবহার করে, যা দুই বা ততোধিক কণার মধ্যে এমন একটি সংযোগ সৃষ্টি করে যেখানে তাদের অবস্থান দূরত্ব নির্বিশেষে পরস্পর নির্ভরশীল থাকে।
তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের একটি বড় সমস্যা হলো কিউবিটের সংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ত্রুটির সম্ভাবনাও বেড়ে যায়। এটি কম্পিউটারের নির্ভরযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। উইলো চিপটি এই ত্রুটি কমানোর জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, এবং নেভেন দাবি করেছেন যে এটি সফল হয়েছে। যদিও এটি এখনো পরিষ্কার নয় যে কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো কখনো এতটা শক্তিশালী এবং নির্ভরযোগ্য হবে যে তারা তাদের উপর আরোপিত প্রত্যাশা পূরণ করতে পারবে।
উইলো চিপ গুগলের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং গবেষণায় একটি বড় অগ্রগতি নির্দেশ করে। এটি এমন সমস্যার সমাধানে সক্ষম যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার দিয়ে সম্ভব নয়। তবে এই চিপের কার্যকারিতার বাস্তব ফলাফল সম্পর্কে জানা গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণস্বরূপ, কিভাবে এই চিপটি বিজ্ঞান, চিকিৎসা, বা আবহাওয়া পূর্বাভাসে উন্নতি আনতে পারে তা বিশদে গবেষণা করা প্রয়োজন।
আরও পড়ুনঃ ৮-ফোটন কিউবিট চিপ কোয়ান্টাম কম্পিউটিং তৈরি করেছে দক্ষিণ কোরিয়ার ইঞ্জিনিয়াররা
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি কেবলমাত্র বৈজ্ঞানিক গবেষণার জন্য নয়, বরং শিল্প ও বাণিজ্যের জন্যও বিপ্লব আনতে পারে। এটি জটিল ডেটা বিশ্লেষণ, ক্রিপ্টোকারেন্সি, এবং সুরক্ষা ব্যবস্থায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এই চিপটি দ্রুত এবং নির্ভুলতার সাথে বিশাল ডেটাসেট বিশ্লেষণ করতে পারে, যা আধুনিক ব্যবসার জন্য অপরিহার্য।
মাল্টিভার্স তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের মধ্যে সম্পর্ক একটি অত্যন্ত জটিল বিষয়। এই ধারণা অনুসারে, প্রতিটি কোয়ান্টাম অবস্থান বা সিদ্ধান্ত নতুন একটি মহাবিশ্ব সৃষ্টি করে। উইলো চিপের কার্যকারিতা যদি সত্যিই এই তত্ত্বকে সমর্থন করে, তবে এটি আমাদের মহাবিশ্বের প্রকৃতি সম্পর্কে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করবে।
তবে, সমালোচকরা উল্লেখ করেছেন যে গুগল যে মানদণ্ড ব্যবহার করেছে, তা সম্পূর্ণরূপে নিরপেক্ষ নয়। উদাহরণস্বরূপ, গুগলের নিজস্ব ডেটা এবং মানদণ্ডের ভিত্তিতে এই চিপের কার্যকারিতা পরিমাপ করা হয়েছে, যা বাইরের বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনার জন্য উপযুক্ত হতে পারে না। তাছাড়া, অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের একই ধরণের চিপের সাথে তুলনা করা হলে এই চিপের বাস্তব কার্যকারিতা সম্পর্কে আরও ধারণা পাওয়া যেতে পারে।
এই চিপের মাধ্যমে গুগলের প্রধান লক্ষ্য হলো কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ত্রুটিগুলি কমানো। এটি যদি সফলভাবে সম্পন্ন হয়, তবে এটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, চিকিৎসা গবেষণায় এটি ক্যান্সারের মতো জটিল রোগের নিরাময়ে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবে, এটি আবহাওয়া পূর্বাভাস বা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বিশ্লেষণে ব্যবহৃত হতে পারে।
অবশেষে, গুগলের উইলো চিপ এবং মাল্টিভার্স তত্ত্ব আমাদের বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তি জগতে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এই প্রযুক্তির বাস্তব প্রভাব এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে জানার জন্য আরও গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণ প্রয়োজন। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি যদি তার প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারে, তবে এটি মানব সভ্যতার জন্য একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে।