গুগল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগের মধ্যে চলমান আইনি বিরোধ নিয়ে সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলা চলছে। বিচারক অমিত মেহতা রায় দিয়েছেন যে, গুগল শেরম্যান অ্যান্টিট্রাস্ট আইনের লঙ্ঘন করেছে। এই রায়ে বলা হয়েছে যে, গুগল তাদের প্রতিযোগীদের বাধা দিয়ে একচেটিয়া বাজার দখল করে রেখেছে। অনেকের কাছে এই ঘটনা ১৯৯৮ সালের মাইক্রোসফটের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের আইনি দ্বন্দ্বের স্মৃতি ফিরিয়ে এনেছে, যেখানে মাইক্রোসফটের ইন্টারনেট এক্সপ্লোরারের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছিল যে, তারা নেটস্কেপকে প্রতিযোগিতার সুযোগ দেয়নি। এবার সেই একই অভিযোগ গুগলের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছে।
বিচারক অমিত মেহতা উল্লেখ করেছেন যে, গুগল তাদের প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে অ্যাপল, স্যামসাং এবং অন্যান্য স্মার্টফোন প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এবং মজিলা ব্রাউজারের সাথে চুক্তি করা, যার ফলে গুগলকে ডিফল্ট সার্চ ইঞ্জিন হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এর জন্য গুগল অ্যাপলকে প্রতিবছর প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে এবং অন্যান্য কোম্পানিগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হয়। এই ধরনের অর্থনৈতিক চুক্তি প্রতিযোগীদের বাজারে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। বিচারক মনে করেন, এই ধরনের চুক্তি এবং কার্যকলাপ প্রতিযোগিতামূলক বাজারকে বাধা দিচ্ছে এবং গ্রাহকদের বিকল্প সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করার সুযোগ কমিয়ে দিচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ কেন গুগল ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি হতে যাচ্ছে ?
গুগল এই রায়কে অসত্য এবং অযৌক্তিক হিসেবে অভিহিত করেছে। গুগলের গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স প্রেসিডেন্ট কেন্ট ওয়াকার বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত স্বীকার করে যে গুগলই সর্বোত্তম সার্চ ইঞ্জিন সরবরাহ করে, তবে আমরা এটিকে সহজলভ্য করতে পারবো না এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।” এই বক্তব্য থেকে বোঝা যায়, গুগল তাদের অবস্থান থেকে সরছে না এবং তারা এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করবে।
ডিপার্টমেন্ট অফ জাস্টিস (ডিওজে) এখন গুগলকে ক্রোম ব্রাউজার বিক্রি করে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে। এই পরিস্থিতি ২০০০ সালের মাইক্রোসফট মামলার সাথে অনেকটাই সাদৃশ্যপূর্ণ। সেই সময় বিচারক টমাস পেনফিল্ড জ্যাকসন রায় দিয়েছিলেন যে, মাইক্রোসফটকে দুইটি কোম্পানিতে ভাগ করা উচিত। একটি কোম্পানি হবে উইন্ডোজের এবং অপরটি মাইক্রোসফটের অন্যান্য সফটওয়্যারের জন্য। কিন্তু সেই রায় বাস্তবায়িত হয়নি এবং মাইক্রোসফটকে বিভক্ত করা হয়নি।
গুগলও একইভাবে তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগকে অস্বীকার করছে। গুগলের ভাইস প্রেসিডেন্ট অফ রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স লি-অ্যান মালহল্যান্ড বলেছেন, “সরকারের এই ধরনের হস্তক্ষেপ গ্রাহক, ডেভেলপার এবং মার্কিন প্রযুক্তি নেতৃত্বের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।” এই মন্তব্যটি প্রমাণ করে যে, গুগল এই আইনি চাপে পড়ে কোনরকম পরিবর্তনের পথে হাঁটতে চায় না।
যদি বিচারক মেহতা গুগলকে ক্রোম ব্রাউজার আলাদা করে দেওয়ার আদেশ দেন, তবে সেটি বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। প্রথমত, গুগল ইতোমধ্যে এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে এবং এটি চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছতে আরও কয়েক বছর সময় লাগবে। বর্তমান মামলা প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনের সময়ে শুরু হয়েছিল এবং সম্ভবত ট্রাম্পের পরবর্তী প্রশাসনের মধ্যেও এর সমাধান হবে না।
প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গুগলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেছেন, গুগল তার সম্পর্কে নেতিবাচক সংবাদ প্রচার করছে এবং তার প্রশাসনের সময় গুগলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেছেন। কিন্তু গুগল ও আলফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাই সম্প্রতি ট্রাম্পের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন এবং তার বিজয়ের পর শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। ট্রাম্পের নীতিমালা তার নিজের অনুভূতির উপর ভিত্তি করে পরিবর্তিত হতে পারে, তাই তিনি যদি চান তবে ডিওজে-কে গুগলের উপর থেকে চাপ সরাতে নির্দেশ দিতে পারেন।
গুগলের সার্চ আধিপত্য শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, ইউরোপীয় ইউনিয়নও গুগলের বিরুদ্ধে অ্যান্টিট্রাস্ট মামলা করেছে এবং ২.৪ বিলিয়ন ইউরো জরিমানা করেছে। যদিও এই জরিমানা গুগলের জন্য তেমন কোনো বড় অর্থ নয়, কারণ ২০২৩ সালে গুগলের আয় ছিল প্রায় ২৩৭.৮৬ বিলিয়ন ডলার। এর মধ্যে শুধুমাত্র ক্রোম ব্রাউজার থেকে আয় হয়েছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার। তাই এই ধরনের জরিমানা গুগলের উপর তেমন কোনো প্রভাব ফেলবে না।
গুগল কি সত্যিই ক্রোম ব্রাউজার আলাদা করে বিক্রি করবে? এমনটা হওয়ার সম্ভাবনা কম। গুগলের কাছে ইতোমধ্যেই ক্রোমিয়াম নামে একটি ওপেন সোর্স সংস্করণ রয়েছে, যা অনেকটা ক্রোমের মতোই। তাই গুগল যদি চায় তবে তারা ক্রোম ব্রাউজারকে সম্পূর্ণ ওপেন সোর্স করে দিতে পারে, যা ডিওজে এবং অন্যান্য আইনি প্রতিদ্বন্দ্বীদের চাপ থেকে মুক্তি দিতে পারে। এই ক্ষেত্রে লিনাক্স ফাউন্ডেশন বা অ্যাপাচি ফাউন্ডেশন এর দায়িত্ব নিতে পারে।
এই পরিস্থিতি থেকে বোঝা যায় যে, গুগলের ক্রোম মনোপলি সহজে ভাঙবে না। গুগল তাদের বাজারে অবস্থান ধরে রাখতে অনেক অর্থ ব্যয় করছে এবং তারা প্রতিযোগিতার বিরুদ্ধে দৃঢ় অবস্থানে রয়েছে। বিচার বিভাগের রায়ে গুগলের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ তোলা হয়েছে, কিন্তু চূড়ান্তভাবে এই মামলা শেষ হতে কয়েক বছর সময় লাগবে এবং এর ফলাফল কী হবে তা নিশ্চিত নয়।
গুগলের এই আধিপত্য কমাতে হলে বাজারে নতুন প্রতিযোগীদের প্রবেশ করতে হবে এবং ব্যবহারকারীদের বিকল্প হিসেবে অন্যান্য ব্রাউজার এবং সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করতে উৎসাহিত করতে হবে। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে গুগলের শক্ত অবস্থান থেকে তারা সহজে সরবে না, এবং তাদের ক্রোম মনোপলি ভাঙা এত সহজ হবে না।
আরও পড়ুনঃ গুগল ম্যাপ এর নতুন আপডেট : এবার আপনার ভ্রমণকে করবে আরো সহজ