পৃথিবীতে জীবনের শুরু কীভাবে হলো? এটি একটি প্রশ্ন যা মানুষকে যুগে যুগে ভাবিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে, প্রথম জীব কোষ কিভাবে তৈরি হলো এবং কীভাবে সেই কোষগুলো গুরুত্বপূর্ণ কোষীয় ঝিল্লির মাধ্যমে জটিল জীবের রূপ নিলো তা সবসময় বিজ্ঞানীদের মনে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে। সাম্প্রতিক গবেষণায় কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গিয়েছে যা আমাদেরকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সাহায্য করছে।
জীবন শুরু হওয়ার জন্য লিপিড মেমব্রেন বা কোষের ঝিল্লি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই ঝিল্লি কোষের অভ্যন্তরের জৈবিক প্রক্রিয়াগুলোর জন্য প্রধান ভূমিকা পালন করে। লিপিড সাধারণত দীর্ঘ শৃঙ্খলযুক্ত ফ্যাটি এসিডের মাধ্যমে তৈরি হয়। তবে প্রশ্ন হলো, পৃথিবীতে জটিল জীবের আগের এই কোষীয় ঝিল্লি কীভাবে তৈরি হয়েছিল, যেখানে সেই সময়ের পৃথিবীতে শুধুমাত্র সহজ সরল অণু ছিল?
বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, প্রাচীন পৃথিবীতে সাধারণত ছোট ফ্যাটি শৃঙ্খলযুক্ত অণু বা ফ্যাটি এসিডের সংখ্যা ছিল কম। তবে কোষের মেমব্রেন গঠনের জন্য দীর্ঘ শৃঙ্খলযুক্ত ফ্যাটি এসিডের প্রয়োজন, যা কোষের জটিল যন্ত্রপাতি ধরে রাখতে সাহায্য করে। যদিও কিছু সহজ ফ্যাটি অণু স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিপিড গঠন করতে সক্ষম হতে পারে, তবুও এই অণুগুলোর প্রচুর পরিমাণে থাকা দরকার ছিল, যা সেই সময়ের পৃথিবীতে সম্ভব ছিল না। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন এবং জৈবরসায়নের অধ্যাপক নিওল দেবরাজ এবং তার গবেষণা দল সম্প্রতি কিছু পরীক্ষা করেছেন যা আমাদের প্রথম কোষের ঝিল্লি তৈরির একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা প্রদান করে। এই গবেষণা সম্প্রতি “নেচার কেমিস্ট্রি” জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষকরা তাদের গবেষণায় দুটি সহজ অণু নিয়ে কাজ শুরু করেন। এই দুটি অণু ছিল একটি অ্যামিনো অ্যাসিড (সিস্টিন) এবং একটি সংক্ষিপ্ত-শৃঙ্খল কোলিন থিওএস্টার, যা সাধারণত ফ্যাটি এসিডের তৈরি এবং ভাঙ্গার জন্য ব্যবহার করা হয়। তারা সিলিকা গ্লাসকে একটি প্রাকৃতিক উৎসেচক হিসেবে ব্যবহার করেন, কারণ এর ঋণাত্মক চার্জযুক্ত সিলিকা, ধনাত্মক চার্জযুক্ত থিওএস্টারের সাথে আকৃষ্ট হয়।
এই সিলিকা পৃষ্ঠে সিস্টিন এবং থিওএস্টার স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিপিডে রূপান্তরিত হয়, যা প্রোটোসেলের মতো ঝিল্লি তৈরি করে। এই প্রক্রিয়াটি এমন ঘনত্বে ঘটেছিল, যা অনুঘটক ছাড়া সম্ভব ছিল না। এর মানে হলো, প্রাচীন পৃথিবীতে এনজাইম ছাড়াই প্রথম লিপিড ঝিল্লি তৈরি হতে পারে, যা প্রাথমিক জীবের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
অধ্যাপক দেবরাজের মতে, এই গবেষণা মূলত দেখিয়েছে কিভাবে জীবনের উৎপত্তি সম্ভব হতে পারে এমন পরিবেশে জীবনের গঠন শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে পৃথিবীতে কোনো এনজাইম ছিল না, অথচ জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় প্রোটোসেল তৈরি হয়েছে। সিলিকার মতো প্রাকৃতিক পদার্থ সম্ভবত প্রাথমিক কোষের গঠন এবং বিকাশে ভূমিকা পালন করেছে।
এই গবেষণা জীবনের উৎপত্তি সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের সম্ভাব্য উত্তর দিয়েছে এবং দেখিয়েছে যে কীভাবে সাধারণ এবং প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশে কোষীয় ঝিল্লি তৈরি হতে পারে। এটি জীববিজ্ঞানের একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি এবং আমাদের বোঝার জন্য একটি নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে যে কীভাবে অজৈব পদার্থ জীবন্ত কোষে রূপান্তরিত হতে পারে। এই প্রক্রিয়া দেখিয়েছে যে সাধারণ প্রাকৃতিক পদার্থ এবং অণুগুলো একত্রিত হয়ে কীভাবে কোষ তৈরি করতে পারে, যা পরবর্তীতে জটিল জীবনের বিকাশের পথে প্রথম পদক্ষেপ ছিল। এই গবেষণার মাধ্যমে আমরা প্রাথমিক জীবনের উৎপত্তি সম্পর্কে একটি ধারণা পেতে পারি। তবে এটি কেবলমাত্র একটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হিসেবে দেখা যেতে পারে, এবং আরও গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। তবুও, এটি জীববিজ্ঞানের জন্য একটি বড় মাইলফলক এবং আমাদের বোঝার জন্য একটি নতুন ধারণা প্রদান করে।
সাম্প্রতিক গবেষণায় যে ধারণা পাওয়া গিয়েছে তা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে পৃথিবীর প্রথম অবস্থায় সাধারণ প্রাকৃতিক অণু এবং পদার্থ কিভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে একত্রিত হয়ে জীবনের শুরু করতে পারে। এই গবেষণার ফলাফল আমাদের বোঝার পরিধিকে আরও বিস্তৃত করেছে এবং দেখিয়েছে যে পৃথিবীতে জীবনের প্রথম পদক্ষেপগুলো কেমন হতে পারে। এটি আমাদের জীববিজ্ঞানের এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাচ্ছে এবং জীবনের উৎস সন্ধানের জন্য আরও নতুন নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করছে।