একটি নতুন গবেষণায় দেখা গেছে যে, পুরুষ গোলকৃমিদের (C. elegans) মস্তিষ্ক একই সাথে দুটি বিপরীতধর্মী স্মৃতি সক্রিয় করতে পারে, তবে এর আচরণ কেবলমাত্র সবচেয়ে বেশি উপকারী স্মৃতি দ্বারা চালিত হয়। এই গবেষণা মস্তিষ্কের তথ্য প্রাধান্যের প্রক্রিয়া সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করেছে, যা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD) এর মতো বিভিন্ন মানসিক অবস্থা বোঝার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে। গবেষণায় কীভাবে কোনো প্রাণীর মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয় যে সে কোনো বিষয়কে ভালো বা খারাপ ভাবে গ্রহণ করবে, তা জানার চেষ্টা করা হয়েছে। এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বোঝা যে, কীভাবে কোনো প্রাণীর মস্তিষ্কের মধ্যে সংঘর্ষপূর্ণ স্মৃতি একসাথে সক্রিয় হতে পারে এবং সেই স্মৃতিগুলো কিভাবে সেই প্রাণীর আচরণকে প্রভাবিত করে।
এই গবেষণাটি ব্রিটেনের ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন (UCL) এর গবেষকগণ পরিচালনা করেছেন। তারা দেখতে পেয়েছেন যে, যখন পুরুষ C. elegans কৃমিকে একই গন্ধের সাথে ইতিবাচক (প্রজনন) এবং নেতিবাচক (ক্ষুধার অভিজ্ঞতা) উভয় ধরনের স্মৃতির সাথে শর্তযুক্ত করা হয়, তখন সেই গন্ধের সংস্পর্শে আসলে তার মস্তিষ্কে উভয় স্মৃতি সক্রিয় হয়, কিন্তু শুধু একটি স্মৃতি তার আচরণকে প্রভাবিত করে। এই ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রজননের ইতিবাচক স্মৃতি ক্ষুধার নেতিবাচক স্মৃতির চেয়ে বেশি প্রভাবশালী হয়ে ওঠে। অর্থাৎ, যখন গন্ধটি প্রজননের সাথে সম্পর্কিত থাকে, তখন কৃমিটি সেই গন্ধের দিকে আকৃষ্ট হয়, ক্ষুধার স্মৃতি থাকা সত্ত্বেও।
আরও পড়ুনঃ এবার আপনার স্বপ্ন রেকর্ড হবে : জাপানি বিজ্ঞানিদের নতুন আবিষ্কার
এই গবেষণাটি পুরুষ C. elegans গোলকৃমির উপর পরিচালিত হয়েছে, যা প্রায় ১ মিলিমিটার দৈর্ঘ্যের এবং প্রায়ই বৈজ্ঞানিক গবেষণার মডেল প্রাণী হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গবেষকরা কৃমিদেরকে এমন একটি গন্ধ প্রদান করেছেন যা সাধারণত তাদের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়। পরে সেই গন্ধের সাথে শাস্তি হিসেবে ক্ষুধা অভিজ্ঞতার সাথে শর্তযুক্ত করা হয়েছিল, যাতে কৃমিরা সেই গন্ধকে এড়াতে শেখে। পরবর্তীতে সেই গন্ধের সাথে প্রজননের ইতিবাচক অভিজ্ঞতা সংযুক্ত করে নতুনভাবে শর্তযুক্ত করা হয়, যাতে কৃমিরা সেই গন্ধের প্রতি ইতিবাচক মনোভাব গড়ে তোলে।
এই গবেষণায় দেখা গেছে যে, একটি নির্দিষ্ট নিউরোপেপটাইড (মস্তিষ্কের রাসায়নিক সংকেতবাহক) উভয় ধরনের স্মৃতিকে মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কোষের মধ্যে সংরক্ষণ করে। এই নিউরোপেপটাইড ক্ষুধা ও প্রজননের স্মৃতি উভয়কে ধারণ করে। কিন্তু যখন কৃমিরা সেই গন্ধের সংস্পর্শে আসে, তখন শুধুমাত্র প্রজননের সাথে সম্পর্কিত স্মৃতিটি তাদের আচরণে প্রভাব ফেলে। গবেষকরা আরও উল্লেখ করেছেন যে, যদিও ক্ষুধার নেতিবাচক স্মৃতিটি মস্তিষ্কে রয়ে গেছে, তা সত্ত্বেও প্রজননের ইতিবাচক স্মৃতি কৃমিকে গন্ধের দিকে আকৃষ্ট করেছে। এটি বোঝায় যে, কোনো পুরস্কারের সম্ভাবনা কোনো শাস্তির ভয়কে অতিক্রম করতে পারে, যদিও উভয় স্মৃতিই মস্তিষ্কে সক্রিয় থাকে।
গবেষণার সহ-প্রথম লেখক ডঃ লরা মোলিনা-গার্সিয়া বলেছেন, “আমরা দেখতে পেয়েছি যে, এমনকি একটি ছোট মস্তিষ্কের প্রাণীর মধ্যে একই সময়ে দুটি বিপরীতধর্মী স্মৃতি সক্রিয় থাকতে পারে, যার মধ্যে একটি স্মৃতি প্রাণীর আচরণকে প্রভাবিত করে এবং অন্যটি সুপ্ত থাকে।”
এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা বোঝাতে চেয়েছেন যে, কীভাবে কোনো প্রাণীর মস্তিষ্ক একটি ঘটনা বা অভিজ্ঞতাকে আংশিকভাবে ভালো এবং আংশিকভাবে খারাপ হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারে এবং এর মাধ্যমে নতুন তথ্যের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে পারে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো স্মৃতি কিভাবে অন্য একটি বিপরীতধর্মী স্মৃতিকে অতিক্রম করে তার বিশ্লেষণ PTSD-এর মতো মানসিক সমস্যার চিকিৎসার ক্ষেত্রে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে পারে।
যে ধরনের সমস্যাগুলির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের এই স্মৃতির সংঘর্ষ প্রাসঙ্গিক হতে পারে, তার মধ্যে PTSD অন্যতম। PTSD-এর ক্ষেত্রে এমন কিছু স্মৃতি, যা সুপ্ত থাকা উচিত, সেগুলো সমস্যা তৈরি করে এবং আবেগ ও আচরণকে প্রভাবিত করে। এই গবেষণার মাধ্যমে এই ধরনের মানসিক সমস্যা বোঝার জন্য এবং তার চিকিৎসায় নতুন উপায় খুঁজে বের করা সম্ভব হতে পারে। গবেষণার প্রধান লেখক ডঃ আরান্তজা ব্যারিওস বলেছেন, “আমাদের গবেষণায় আমরা পুরুষ কৃমির মস্তিষ্ক নিয়ে কাজ করেছি, যাতে আমরা বোঝার চেষ্টা করেছি যে, কোন সেলুলার বা মলিকুলার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কোনো স্মৃতি প্রাণীর আচরণকে প্রভাবিত করে। আমাদের শেখার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল যে, আমাদের মস্তিষ্ক নতুন তথ্যের সাথে খাপ খাইয়ে পূর্বের সম্পর্কগুলোকে অতিক্রম করতে সক্ষম।”
অন্য এক সহ-প্রথম লেখক ডঃ সুসানা কোলিনাস ফিশার আরও বলেছেন, “একটি ছোট কৃমি কী ভাবছে তা বুঝতে পারার মাধ্যমে আমরা আমাদের নিজেদের আরও জটিল চিন্তা প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে পারি।”
এই গবেষণা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, প্রাণীর মস্তিষ্ক সংঘর্ষপূর্ণ স্মৃতির মধ্যে কিভাবে সবচেয়ে উপকারী স্মৃতিটিকে প্রাধান্য দেয়। মস্তিষ্কের এই প্রক্রিয়া আমাদের শেখার এবং নতুন তথ্যের সাথে মানিয়ে চলার ক্ষমতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একই সাথে এই গবেষণা PTSD-এর মতো মানসিক সমস্যাগুলি বোঝার জন্য এবং তার চিকিৎসায় নতুন সুযোগ উন্মুক্ত করে দেয়, যেখানে সুপ্ত থাকা উচিত এমন স্মৃতিগুলো আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।