মানুষের জীবনে স্ট্রেস বা মানসিক চাপ একটি সাধারণ অভিজ্ঞতা। তবে, একই ধরনের স্ট্রেস বিভিন্ন ব্যক্তির ওপর ভিন্ন ভিন্ন প্রভাব ফেলে। কেউ কেউ সহজেই এই চাপ কাটিয়ে ওঠে এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসে, আবার কেউ কেউ এই চাপের কারণে বিষণ্নতার মধ্যে আটকে পড়ে। সম্প্রতি ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়া, স্যানফ্রানসিসকোর (UCSF) গবেষকরা এই বিষয়ে একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধন করেছেন, যা বিষণ্নতার চিকিৎসায় নতুন এক সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে।
স্ট্রেস এবং মস্তিষ্কের প্রতিক্রিয়া
মানসিক চাপ আমাদের মস্তিষ্কে নির্দিষ্ট কিছু পরিবর্তন ঘটায়, যা আমাদের আবেগ এবং আচরণকে প্রভাবিত করে। UCSF-এর গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা নামক একটি অংশ এই প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অ্যামিগডালা মস্তিষ্কের সেই অংশ যা আমাদের আবেগ, স্মৃতি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের সাথে যুক্ত। গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, স্ট্রেসের কারণে অ্যামিগডালার কার্যকলাপে পরিবর্তন ঘটে, যা বিভিন্ন ব্যক্তির স্ট্রেস মোকাবিলার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। যেসব মস্তিষ্কে অ্যামিগডালার কার্যকলাপ কম ছিল, তারা স্ট্রেস থেকে দ্রুত সেরে উঠতে পেরেছে। অন্যদিকে, যাদের অ্যামিগডালার কার্যকলাপ বেশি ছিল, তারা বিষণ্নতায় ভুগেছে।
আরও পড়ুনঃ এমআরএনএ চিকিৎসার মাধ্যমে ইনজেকশন ছাড়াই ঔষধ সেবন
ইঁদুরের উপর পরীক্ষা
এই গবেষণায় ইঁদুরের মডেল ব্যবহার করা হয়েছে। গবেষকরা লক্ষ্য করেন যে, স্ট্রেস দেওয়ার পর ইঁদুরগুলোর মস্তিষ্কে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। স্ট্রেসপ্রাপ্ত ইঁদুরদের মধ্যে যারা সুস্থ স্বাভাবিক আচরণ করতে পেরেছে, তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ ভিন্ন ধরনের ছিল। অন্যদিকে, যারা স্ট্রেসের কারণে বিষণ্নতায় ভুগেছে, তাদের মস্তিষ্কের অ্যামিগডালা এবং হিপোক্যাম্পাসের মধ্যে সংযোগে অসামঞ্জস্য দেখা গেছে।
কেমোজেনেটিক পদ্ধতির ব্যবহার
গবেষকরা ইঁদুরের মস্তিষ্কে বিশেষ কেমোজেনেটিক প্রযুক্তি ব্যবহার করেন। এই পদ্ধতিতে, একটি কৃত্রিম অণু ইঁদুরের মস্তিষ্কে প্রবেশ করানো হয়, যা নির্দিষ্ট নিউরনগুলোকে সক্রিয় করে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা অ্যামিগডালা এবং হিপোক্যাম্পাসের মধ্যে সংযোগ পুনরায় স্থাপন করতে সক্ষম হন। ফলে ইঁদুরগুলোর বিষণ্নতার লক্ষণগুলি দূর হয়ে যায় এবং তারা সুস্থ আচরণ প্রদর্শন করতে শুরু করে। একজন গবেষক, ফ্রান্সেস জিয়া, এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা যখন অ্যামিগডালা এবং হিপোক্যাম্পাসের মধ্যে নিউরনের কার্যকলাপ বাড়ানোর চেষ্টা করি, তখন ইঁদুরগুলোর বিষণ্নতা দূর হয়ে যায়। এটি আমাদের কাছে এক অভূতপূর্ব সাফল্য।”
মানুষের ক্ষেত্রে সম্ভাব্য প্রয়োগ
গবেষকরা মনে করছেন, ইঁদুরের ক্ষেত্রে কার্যকর এই পদ্ধতি মানুষের বিষণ্নতার চিকিৎসায়ও ব্যবহার করা যেতে পারে। UCSF-এর গবেষণা দলের প্রধান, ড. মাজেন খাইরবেক বলেন, “আমরা যদি মানুষের মস্তিষ্কেও একই ধরনের নিউরন সক্রিয় করতে পারি, তবে এটি বিষণ্নতার বিরুদ্ধে একটি অ-আক্রমণাত্মক চিকিৎসা পদ্ধতি হয়ে উঠতে পারে।”
তিনি আরও জানান, গবেষণা দল বর্তমানে মানুষের মস্তিষ্কের ডেটা নিয়ে কাজ করছে। তারা অ্যামিগডালা এবং হিপোক্যাম্পাসের মধ্যে সংযোগ নিয়ে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করছেন। যদি এই সংযোগে বিষণ্নতার সাথে সম্পর্কিত কোনো নির্দিষ্ট প্যাটার্ন পাওয়া যায়, তবে তা থেকে একটি কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবন করা সম্ভব হতে পারে।
বর্তমানে বিষণ্নতার চিকিৎসায় ব্যবহৃত পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ওষুধ, সাইকোথেরাপি এবং লাইফস্টাইল পরিবর্তন। তবে, অনেক ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিগুলো সব রোগীর জন্য কার্যকর হয় না। UCSF-এর এই গবেষণা বিষণ্নতার চিকিৎসায় একটি নতুন পথ উন্মোচন করেছে, যা নিউরনের কার্যকলাপ পরিবর্তনের মাধ্যমে রোগীর মানসিক অবস্থা উন্নত করতে পারে। গবেষকরা বলছেন, এই পদ্ধতি যদি মানুষের ক্ষেত্রে সফল হয়, তবে এটি বিষণ্নতার চিকিৎসায় একটি বড় বিপ্লব আনবে। এটি ওষুধ বা সাইকোথেরাপির বিকল্প হতে পারে এবং রোগীদের জন্য একটি সহজ, নিরাপদ এবং কার্যকর সমাধান প্রদান করতে পারে।
গবেষণা দল বর্তমানে বিষণ্নতার এই চিকিৎসা পদ্ধতি নিয়ে আরও গভীর গবেষণা করছে। তারা মানুষের মস্তিষ্কে অ্যামিগডালা এবং হিপোক্যাম্পাসের মধ্যে সংযোগ নিয়ে বিস্তারিত কাজ করছেন। এর পাশাপাশি, এই পদ্ধতিতে ব্যবহৃত কেমোজেনেটিক প্রযুক্তির কার্যকারিতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
UCSF-এর এই গবেষণা বিষণ্নতার চিকিৎসায় একটি নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যদি এই পদ্ধতি মানুষের ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়, তবে এটি কোটি কোটি মানুষের জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে। বিষণ্নতা এমন একটি সমস্যা যা শুধুমাত্র ব্যক্তির নয়, পুরো সমাজের ওপর প্রভাব ফেলে। তাই, এই গবেষণার ফলাফল আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
চিকিৎসা ও পরিবেশ রক্ষায় ন্যানোমেকানিক্যাল রেজোনেটর প্রযুক্তি