হুয়াওয়ে এবার ফাইনালি সম্পূর্ণরূপে অ্যান্ড্রয়েড থেকে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেছে। এখন চীনের এই জাইন্ট প্রতিষ্ঠানটি তাদের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেম হারমনি ওএস নেক্সট (HarmonyOS NEXT) প্রকাশ করেছে। এই পদক্ষেপটি কোম্পানির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ এটি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর চীনা প্রযুক্তির আত্মনির্ভরশীলতার দিকে একটি বড় পদক্ষেপ। হারমনি ওএস নেক্সটের মাধ্যমে হুয়াওয়ে প্রমাণ করছে যে তারা কেবল অ্যান্ড্রয়েডের ওপেন সোর্স প্রজেক্ট থেকে সরে আসেনি, বরং সম্পূর্ণভাবে নিজস্ব ভিত্তি থেকে একটি নতুন অপারেটিং সিস্টেম তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে।
হারমনি ওএস নেক্সট এর সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হল এটি আর অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপগুলিকে সমর্থন করে না। এই নতুন সিস্টেমটি মূলত চীনের শীর্ষস্থানীয় অ্যাপ ডেভেলপারদের লক্ষ্য করে তৈরি করা হয়েছে। হুয়াওয়ে জানিয়েছে যে মেইটুয়ান, ডোইন, টাওবাও, শাওহোংশু, আলিপে এবং জেডি.কমের মতো জনপ্রিয় চীনা অ্যাপগুলো হারমনি ওএস নেক্সটের জন্য বিশেষভাবে ডেভেলপ করা হয়েছে। বর্তমানে, এই অপারেটিং সিস্টেমে ১৫,০০০ এরও বেশি নেটিভ অ্যাপ এবং মেটা-সার্ভিস উপলব্ধ রয়েছে। যদিও এই সংখ্যা গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপলের অ্যাপ স্টোরের তুলনায় বেশ কম, তবে চীনের মতো বড় বাজারের জন্য এটি একটি শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করছে।
আরও পড়ুনঃ শীঘ্রই বাজারে আসতে যাচ্ছে ইলন মাস্ক-এর টেসলা পাই ফোন: জেনে নিন কি কি চমক থাকছে এই ফোনে
হারমনি ওএস নেক্সট শুধুমাত্র স্মার্টফোন ও ট্যাবলেটেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি অন্যান্য প্ল্যাটফর্মেও ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত হচ্ছে। হুয়াওয়ে ঘোষণা করেছে যে ভবিষ্যতে তাদের পিসিতেও হারমনি ওএস ব্যবহার করা হবে এবং তারা মাইক্রোসফট উইন্ডোজ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। এই পদক্ষেপটি শুধুমাত্র চীনের প্রযুক্তি খাতে নির্ভরশীলতা কমাতে সাহায্য করবে না, বরং অন্যান্য প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকেও তাদের নিজস্ব অপারেটিং সিস্টেমে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত করবে।
হারমনি ওএস নেক্সটের পারফরমেন্সকে আরও উন্নত করার লক্ষ্যে হুয়াওয়ে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছে। সিস্টেমটি প্রায় ৩০ শতাংশ দ্রুত কাজ করে এবং এটি ব্যাটারি লাইফকে প্রায় ৫৬ মিনিট বৃদ্ধি করে। এছাড়াও, এটি ডিভাইসের প্রায় ১.৫ গিগাবাইট মেমরি ফ্রি রাখতে সক্ষম, যা ডিভাইসের সাধারণ কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। হুয়াওয়ে দাবি করেছে যে এই অপারেটিং সিস্টেমের ১১০ মিলিয়নের বেশি লাইন কোড রয়েছে, যা এটি একটি পূর্ণাঙ্গ অপারেটিং সিস্টেম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
চীনের নিজস্ব প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো তৈরির এই প্রচেষ্টার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে দেশটির প্রযুক্তি খাতকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার প্রভাব থেকে সুরক্ষিত রাখা। হারমনি ওএস নেক্সট এমন একটি সময়ে এসেছে যখন চীনের প্রযুক্তি খাত নিজস্ব সফটওয়্যার ও হার্ডওয়্যার বিকাশের জন্য নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষত ২০১৯ সালে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর হুয়াওয়ে তাদের গুগল মোবাইল সার্ভিস থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নিজের পথ তৈরি করতে বাধ্য হয়েছিল।
হারমনি ওএস নেক্সটের আরেকটি বড় বৈশিষ্ট্য হল এর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। হুয়াওয়ে দাবি করেছে যে নতুন অপারেটিং সিস্টেমটি আগের তুলনায় অনেক বেশি সুরক্ষিত এবং ব্যবহারকারীদের তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এটি আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে। চীনে এই সিস্টেমের মাধ্যমে মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট এবং এমনকি কারের জন্যও নতুন যুগের সংযোগ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
হুয়াওয়ে আরও জানিয়েছে যে বর্তমানে হারমনি ওএস সমর্থিত ডিভাইসের সংখ্যা ১ বিলিয়নের বেশি। এ ছাড়া, ৬.৭৫ মিলিয়নেরও বেশি ডেভেলপার তাদের সাথে যুক্ত হয়েছে এবং চীনের ৩০০ টিরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয় তাদের সাথে গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে। এর মাধ্যমে চীনের প্রযুক্তি খাত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে এবং নিজস্ব পরিকাঠামো তৈরির পথে অগ্রসর হচ্ছে।
হারমনি ওএসের বাজারে প্রবেশের পর থেকেই এর জনপ্রিয়তা দ্রুত বেড়েছে। ২০২৪ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকে হারমনি ওএস চীনের বাজারে ১৭ শতাংশ শেয়ার দখল করে নিয়েছে, যা আইওএসকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে হারমনি ওএস এখনও তেমনভাবে ছড়িয়ে পড়েনি, তবে চীনের বাজারে এটি দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
হারমনি ওএস নেক্সটের প্রধান চ্যালেঞ্জ হল একটি শক্তিশালী অ্যাপ্লিকেশন ইকোসিস্টেম তৈরি করা। যদিও বর্তমানে ১৫,০০০ এরও বেশি অ্যাপ আছে, কিন্তু এটি গুগল প্লে স্টোর বা অ্যাপ স্টোরের সাথে তুলনীয় নয়। হুয়াওয়ে জানিয়েছে যে তারা দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগ এবং একাধিক পক্ষের সহযোগিতার মাধ্যমে এই ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।