ল্যাবের মধ্যে তৈরি মানব মস্তিষ্কের কোষ কীভাবে একটি ভার্চুয়াল প্রজাপতিকে পরিচালনা করতে পারে এই বিষয়টি বিজ্ঞানীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক স্টার্টআপ ফাইনাল-স্পার্ক এই অভিনব গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের তৈরি একটি 3D সিমুলেশনে দেখা যাচ্ছে, মানব মস্তিষ্কের কোষের নির্দেশনার মাধ্যমে ভার্চুয়াল প্রজাপতিটি উড়ছে এবং সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।
ফাইনাল-স্পার্কের তৈরি ন্যুরোপ্ল্যাটফর্ম গবেষণার ক্ষেত্রে বায়োকম্পিউটিংয়ের সম্ভাবনাকে উন্মুক্ত করছে। বিজ্ঞানীরা এখন কোড লিখতে পারছেন যা এই ক্ষুদ্র মস্তিষ্ক অর্গানয়েডগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে সক্ষম। অর্গানয়েড বলতে বোঝানো হচ্ছে এমন ক্ষুদ্র মস্তিষ্কের কোষ, যেগুলো ইন্ডিউসড প্লুরিপোটেন্ট স্টেম সেলস থেকে তৈরি হয়েছে। এই কোষগুলো মস্তিষ্কের মতো আচরণ করে, যদিও এদের জটিলতা মানুষের আসল মস্তিষ্কের মতো নয়। তবুও, এরা বহিরাগত উদ্দীপনার প্রতি সাড়া দেয় এবং ফাইনাল-স্পার্কের তৈরি মাল্টি-ইলেক্ট্রোড অ্যারে (MEA) মাধ্যমে দ্বিমুখী বিদ্যুৎপ্রবাহের মাধ্যমে যোগাযোগ করতে সক্ষম।
আরও পড়ুনঃ টোকিও বিজ্ঞানীদের নতুন আবিষ্কার, কার্বন ডাই-অক্সাইড থেকে ফর্মেট জ্বালানি তৈরি
এই প্রজেক্টের অন্যতম উদ্যোগ হিসেবে, মস্তিষ্কের কোষগুলোর উদ্দীপনার ওপর ভিত্তি করে একটি ভার্চুয়াল প্রজাপতির উড্ডয়ন সিমুলেট করা হয়েছে। ব্যবহারকারী যখন কোনো সুনির্দিষ্ট স্থানে ক্লিক করেন, তখন কোষগুলো সেই সংকেতের প্রতি সাড়া দেয় এবং সিদ্ধান্ত নেয় যে প্রজাপতিটি ওই স্থানটি লক্ষ্য করে যাবে কিনা। উদাহরণস্বরূপ, একটি পাইথন কোডের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া দেখানো হলো:
এই প্রযুক্তির মূল আকর্ষণ হচ্ছে মানব মস্তিষ্কের কোষগুলো কীভাবে কম শক্তি খরচ করে জটিল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, মানুষের মস্তিষ্ক মাত্র ২০ ওয়াট শক্তিতে কাজ করতে পারে, যেখানে এই প্রযুক্তির বিকাশ ঘটানোর মাধ্যমে কম শক্তি খরচে উচ্চতর পারফরম্যান্স পাওয়া সম্ভব হতে পারে। এর চেয়ে বর্তমান এআই মডেলগুলো চালু রাখতে প্রচুর শক্তির প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, হিউলেট প্যাকার্ডের ফ্রন্টিয়ার সুপার কম্পিউটার প্রায় ২১ মেগাওয়াট শক্তি খরচ করে।
বায়োলজিকাল নিউরাল নেটওয়ার্ক (BNN) বা জীববৈজ্ঞানিক স্নায়বিক নেটওয়ার্কের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা রয়েছে, যেমন সৃজনশীলতা, প্রকৃত জিরো-শট লার্নিং ক্ষমতা, শক্তিশালী প্যাটার্ন শনাক্তকরণ ও জেনারেলাইজেশন, এবং অস্বচ্ছতা ও গোলমাল হ্যান্ডেল করার উন্নত ক্ষমতা। এছাড়াও, BNN এর মাধ্যমে স্ব-মেরামতি এবং নিউরোপ্লাস্টিসিটির মতো বৈশিষ্ট্য অর্জন করা সম্ভব।
দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়ে দিবে ইলন মাস্ক এর নিউরালিংকের ব্লাইন্ডসাইট ইমপ্ল্যান্ট
বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি শূন্য-শট লার্নিং এবং সৃজনশীলতার মতো জটিল কাজ সম্পাদনের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নতি আনতে সক্ষম হবে। বরগার উল্লেখ করেছেন যে, এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশে অভিজ্ঞতা ছাড়াই কাজ করার দক্ষতা অর্জন করা যাবে। ফাইনাল-স্পার্কের মতে, এই প্রযুক্তি মানসিক সংরক্ষণ ও মন আপলোডিং-এর মতো ভবিষ্যৎ ধারণাগুলোর পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
এ ধরনের প্রযুক্তির সঙ্গে একাধিক নৈতিক প্রশ্নও জড়িত। মস্তিষ্কের কোষের এই প্রয়োগে কি মানুষের মতো চেতনাও তৈরি হতে পারে? বরগার এই প্রশ্নের জবাবে উল্লেখ করেছেন যে, এই মস্তিষ্ক অর্গানয়েডগুলো উচ্চতর চেতনার ক্ষমতা রাখে না, এবং এদেরকে মানুষের তুলনায় গাছপালার মতো ভাবা উচিত। তবে, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি আরও উন্নত হতে পারে এবং মানব জীবনের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে কগনিটিভ প্রসেসের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে।
এই প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় সম্ভাবনা হলো এর মাধ্যমে মানুষের মস্তিষ্কের সংরক্ষণ ও আয়ুষ্কালের উন্নয়ন। বরগারের মতে, মানুষের মস্তিষ্কের গঠনগত ও কার্যগত অখণ্ডতা সংরক্ষণ করার মাধ্যমে বার্ধক্য এবং কগনিটিভ ক্ষয় মোকাবেলা করা সম্ভব হতে পারে। এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতে মানব জ্ঞানীয় অগ্রগতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।
শব্দের ব্যাখ্যা-
[জ্ঞানীয় অগ্রগতি:- বলতে বোঝানো হয় মানুষের মস্তিষ্কের চিন্তা, শেখা, মনে রাখা, সমস্যা সমাধান করা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার উন্নতি। সহজভাবে বললে, এটি হলো মস্তিষ্কের সেই দক্ষতাগুলোর উন্নয়ন যা আমাদের পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে, নতুন তথ্য শিখতে এবং বিভিন্ন জটিল সমস্যা সমাধান করতে সহায়তা করে।]
তথ্য সূত্রঃ দ্যা রেজিষ্টার ডট কম