ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক এর মধ্যে পার্থক্য

 ইন্টারনেট কী?

সহজ ভাষায় বলতে গেলে, ইন্টারনেট হল বিশ্বব্যাপী একটি বিশাল কম্পিউটার নেটওয়ার্ক। এটি বিলিয়ন বিলিয়ন কম্পিউটার, স্মার্টফোন, এবং অন্যান্য ডিভাইসকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে। এই সংযোগের মাধ্যমে আমরা তথ্য আদান-প্রদান করতে পারি, যোগাযোগ করতে পারি এবং বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারি। ইন্টারনেটের ব্যবহার অসীম। এটি আমাদের জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই ব্যবহৃত হয়। যেমন: ১। গুগল, বিং, ইয়াহু ইত্যাদি সার্চ ইঞ্জিনের মাধ্যমে আমরা যে কোন বিষয়ে তথ্য খুঁজে পেতে পারি। ২। ইমেইল, সোশ্যাল মিডিয়া, ভিডিও কল ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা বিশ্বের যে কোন প্রান্তের মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারি।

ইন্টারনেটের ইতিহাস

ইন্টারনেট, যা আজ আমাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ, এর যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬০-এর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের একটি প্রকল্পের মাধ্যমে। এই প্রকল্পের নাম ছিল ARPANET (Advanced Research Projects Agency Network)। মূলত, এটি ছিল একটি পরীক্ষামূলক নেটওয়ার্ক যা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করতে সাহায্য করত। ১৯৬৯ সালে ARPANET প্রথমবারের মতো চারটি কম্পিউটারকে সংযুক্ত করে এবং এটিই ইন্টারনেটের প্রথম রূপ।

ইমেইলের উদ্ভব: ১৯৭০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ইমেইল জনপ্রিয় হতে শুরু করে। ১৯৭১ সালে Ray Tomlinson নামের একজন প্রোগ্রামার প্রথমবারের মতো ইমেইল সিস্টেম তৈরি করেন, যেখানে “@” চিহ্নটি প্রাপক এবং সার্ভারের মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ করে। TCP/IP প্রোটোকল: ইন্টারনেটের মূল ভিত্তি হলো TCP/IP প্রোটোকল, যা ১৯৮০-এর দশকে তৈরি করা হয়েছিল। এই প্রোটোকলটি তৈরি করেন Vint Cerf এবং Robert Kahn। এটি ছিল একটি স্ট্যান্ডার্ড কমিউনিকেশন প্রোটোকল, যা বিভিন্ন নেটওয়ার্ককে একসঙ্গে কাজ করতে সাহায্য করে এবং ইন্টারনেটকে একক প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত করে।

ডোমেইন নেম সিস্টেম (DNS): ১৯৮৩ সালে DNS (Domain Name System) প্রবর্তিত হয়, যা ইন্টারনেটের বিভিন্ন সাইটকে সহজে মনে রাখার মতো নাম দেয়। উদাহরণস্বরূপ, www.google.com এর মতো ওয়েবসাইট নামের মাধ্যমে মানুষ সহজেই ওয়েবসাইট অ্যাক্সেস করতে পারে, যা আগে শুধু IP ঠিকানা দিয়ে করা হতো।

ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW): ইন্টারনেটকে সত্যিকারের জনপ্রিয় করে তোলে ১৯৮৯ সালে Tim Berners-Lee-এর উদ্ভাবিত ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (WWW)। এটি হলো হাইপারলিংকিং এবং ব্রাউজিংয়ের মাধ্যমে তথ্য প্রদর্শনের একটি পদ্ধতি, যা ইন্টারনেটকে একটি ব্যবহারযোগ্য প্ল্যাটফর্মে রূপান্তরিত করে।

বাণিজ্যিক ইন্টারনেটের উত্থান: ১৯৯০-এর দশক থেকে ইন্টারনেট বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহৃত হতে শুরু করে। ই-মেইল, ওয়েবসাইট, সার্চ ইঞ্জিন (যেমন গুগল), এবং ই-কমার্স (যেমন অ্যামাজন) দ্রুত জনপ্রিয় হতে থাকে। ধীরে ধীরে ইন্টারনেট একটি বৈশ্বিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং তথ্যভাণ্ডারে পরিণত হয়।

আধুনিক ইন্টারনেট: আজকের দিনে ইন্টারনেট কেবল একটি যোগাযোগ মাধ্যম নয়, এটি আমাদের জীবনের সকল ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন শিক্ষা, ই-কমার্স, স্ট্রিমিং পরিষেবা—সবকিছুই ইন্টারনেটের মাধ্যমে সহজ এবং কার্যকরী হয়েছে। বর্তমানে বিশ্বের কয়েকশো কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন এবং এটি ক্রমাগত পরিবর্তন ও উন্নতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।

 

নেটওয়ার্ক কী?

নেটওয়ার্ক হল দুই বা ততোধিক ডিভাইসের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের একটি ব্যবস্থা। যেমন, আপনার বাড়ির কম্পিউটার, মোবাইল ফোন, ট্যাবলেট ইত্যাদি যখন ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে অপরের সাথে যুক্ত হয়, তখন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি হয়।

নেটওয়ার্কের মূল কাজ তথ্য আদান-প্রদান করা। এটি ছবি, ভিডিও, ফাইল, ইমেইল ইত্যাদি যেকোন ধরনের তথ্য হতে পারে। নেটওার্ক তৈরির জন্য বিভিন্ন ধরনের হার্ডওয়্যার এবং সফটওয়্যারের প্রয়োজন হয়। যেমন: কম্পিউটার, রাউটার, সুইচ, মডেম, নেটওয়ার্ক কেবল ইত্যাদি। নেটওয়ার্কের ধরন হিসাবে নেটওার্ককে বিভিন্ন ভাবে ভাগ করা যায়, যেমন: ১। লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (LAN): ছোট এলাকা, যেমন একটি বাড়ি বা অফিসে ব্যবহৃত নেটওয়ার্ক। ২। মেট্রোপলিটান এরিয়া নেটওয়ার্ক (MAN): একটি শহরের মধ্যে বিস্তৃত নেটওয়ার্ক। ৩। ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক (WAN): বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত নেটওয়ার্ক, যেমন ইন্টারনেট।

নেটওয়ার্কের ব্যবহার: নেটওয়ার্ক আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ইন্টারনেট ব্যবহার করি, ইমেইল পাঠাই, ফাইল শেয়ার করি, অনলাইন গেম খেলি, ভিডিও কল করি এবং আরও অনেক কিছু করি। উদাহরণ: আপনার বাড়িতে একটি ওয়াই-ফাই রাউটার আছে। এই রাউটারটি আপনার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ এবং অন্যান্য ডিভাইসকে ইন্টারনেটের সাথে সংযুক্ত করে। এই সংযোগটি একটি লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (LAN)। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আপনি ইন্টারনেটে ব্রাউজ করতে পারেন, ইমেইল চেক করতে পারেন এবং অন্যান্য অনলাইন কাজ করতে পারেন।

 

ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক এর মধ্যে পার্থক্য

ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক এর মধ্যে পার্থক্য করার সময় আমরা ইন্টারনেট ও নেটওয়ার্ক শব্দ দুটি একই অর্থে ব্যবহার করি। কিন্তু আসলে এই দুইটির মধ্যে কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। চলুন বিস্তারিত জেনে নিই:

নেটওয়ার্ক

  • সংজ্ঞা: নেটওয়ার্ক হল দুই বা ততোধিক ডিভাইস (যেমন কম্পিউটার, স্মার্টফোন, প্রিন্টার) এর মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের একটি ব্যবস্থা। এটি একটি ছোট অফিস, একটি বাড়ি বা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত হতে পারে।
  • উদাহরণ: আপনার বাড়ির ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক, অফিসের ল্যান (LAN) নেটওয়ার্ক, ইত্যাদি।
  • প্রকারভেদ: লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক (LAN), মেট্রোপলিটান এরিয়া নেটওয়ার্ক (MAN), ওয়াইড এরিয়া নেটওয়ার্ক (WAN) ইত্যাদি।

ইন্টারনেট

  • সংজ্ঞা: ইন্টারনেট হল বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত একটি বিশাল নেটওয়ার্ক। এটি বিলিয়ন বিলিয়ন কম্পিউটার, স্মার্টফোন এবং অন্যান্য ডিভাইসকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করে।
  • উদাহরণ: আপনি যখন গুগলে কোন কিছু সার্চ করেন বা ফেসবুকে পোস্ট করেন, তখন আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করছেন।
  • প্রকারভেদ: ইন্টারনেট মূলত একটি WAN (Wide Area Network)।

সারসংক্ষেপে:

  • নেটওয়ার্ক হল একটি সাধারণ শব্দ যা দুই বা ততোধিক ডিভাইসের সংযোগকে বোঝায়।
  • ইন্টারনেট হল একটি বিশেষ ধরনের নেটওয়ার্ক যা বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত।

উদাহরণ দিয়ে বুঝানো যাক:

  • আপনার বাড়ির ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক একটি লোকাল এরিয়া নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আপনি আপনার বাড়ির বিভিন্ন ডিভাইসকে একে অপরের সাথে সংযুক্ত করতে পারেন।
  • যখন আপনি এই ওয়াইফাই নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে ইন্টারনেটে ব্রাউজ করেন, তখন আপনি বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত ইন্টারনেট নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয়ে যান।

 

উপসংহার

ইন্টারনেট এবং নেটওয়ার্ক দুটোই আমাদের আধুনিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আমরা একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ডিভাইসগুলোকে সংযুক্ত করে যোগাযোগ স্থাপন করি, আর ইন্টারনেট সেই সংযোগকে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত করে দেয়। ইন্টারনেট মূলত অনেকগুলো নেটওয়ার্কের সমন্বয়ে গঠিত, যা পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তে তথ্য আদান-প্রদান সম্ভব করে। এক কথায়, নেটওয়ার্ক হলো সংযোগের বুনিয়াদ, আর ইন্টারনেট সেই বুনিয়াদকে বিশ্বজুড়ে বিস্তৃত করে। আপনার বাড়ি থেকে অফিস, অফিস থেকে গোটা পৃথিবী—এই পুরো ব্যবস্থাই নেটওয়ার্ক ও ইন্টারনেটের মাধ্যমে সম্ভব হচ্ছে। এই দুটির সঠিক ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা যোগাযোগ, তথ্যপ্রাপ্তি এবং কাজের গতি বৃদ্ধি করতে পারি, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে আরও সহজ এবং কার্যকরী করে তুলছে।

Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো