আমাদের মহাবিশ্ব কি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে? নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের নতুন তথ্য

আমরা কি একটি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে বসবাস করছি? সম্প্রতি জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের পর্যবেক্ষণে এমন কিছু তথ্য পাওয়া গেছে যা এই ধারণাকে সমর্থন করতে পারে। ১৯১৬ সালে জার্মান পদার্থবিদ কার্ল শোয়ার্জশিল্ড আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে একটি সমীকরণ তৈরি করেন, যা পরবর্তীতে ব্ল্যাক হোলের অস্তিত্বের গণিতগত ভিত্তি হিসেবে বিবেচিত হয়। পরবর্তীতে ১৯৭০-এর দশকে বিজ্ঞানী রাজ কুমার পাঠরিয়া এবং আই. জে. গুড এই তত্ত্বের উপর আরও গবেষণা করেন এবং ধারণা দেন যে, আমাদের মহাবিশ্ব আসলে একটি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে অবস্থিত হতে পারে। তাদের মতে, শোয়ার্জশিল্ড ব্যাসার্ধ, যা আমরা বর্তমানে “ইভেন্ট হরাইজন” নামে জানি, এটি শুধু একটি ব্ল্যাক হোলের সীমারেখা নয়, বরং আমাদের মহাবিশ্বের সীমানাও হতে পারে। সহজ কথায়, এটি বোঝায় যে আমাদের মহাবিশ্ব নিজেই একটি বৃহত্তর মহাবিশ্বের একটি ব্ল্যাক হোলের মধ্যে অবস্থান করছে।

জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের JADES (জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ অ্যাডভান্সড ডিপ এক্সট্রাগ্যালাকটিক সার্ভে) প্রকল্পের মাধ্যমে মহাবিশ্বের প্রাচীনতম এবং দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে ২৬৩টি গ্যালাক্সির ঘূর্ণন দিক বিশ্লেষণ করা হয়।

সাধারণত ধরে নেওয়া হয় যে মহাবিশ্ব বড় পরিসরে সমজাতীয় এবং সমকোণীয় অর্থাৎ এটি সর্বত্র একই রকম এবং সব দিক থেকেই অভিন্ন দেখায়। যদি এই ধারণা সত্যি হতো, তাহলে গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণন দিক সমানভাবে বণ্টিত থাকার কথা, অর্থাৎ ৫০% গ্যালাক্সি ঘড়ির কাঁটার দিকে এবং ৫০% বিপরীত দিকে ঘুরবে। কিন্তু গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় এক-তৃতীয়াংশ গ্যালাক্সি ঘড়ির কাঁটার বিপরীতে ঘুরছে, আর দুই-তৃতীয়াংশ গ্যালাক্সি ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরছে। গবেষকরা বলছেন, এই পার্থক্য এতটাই স্পষ্ট যে এটি দেখার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ চোখেই বোঝা যায় যে গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণনের মধ্যে এই অসমতা বিদ্যমান।

গবেষকরা এই পার্থক্যের দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন:

  • মহাবিশ্ব জন্ম থেকেই ঘূর্ণায়মান: যদি মহাবিশ্ব সত্যিই একটি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে থাকে, তাহলে এটি একটি নির্দিষ্ট গতিশীল কাঠামোর মধ্যে থাকতে পারে। ব্ল্যাক হোলের মধ্যকার মহাবিশ্ব যদি ঘূর্ণনশীল হয়, তবে এটি তার অভ্যন্তরস্থ গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণনের দিককেও প্রভাবিত করতে পারে। এই তত্ত্বের সত্যতা প্রতিষ্ঠিত হলে, আমাদের মহাবিশ্বের উৎপত্তি এবং গঠন সম্পর্কে প্রচলিত অনেক ধারণা পরিবর্তন করতে হবে।
  • ডপলার প্রভাব: পৃথিবী যখন মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রের চারপাশে ঘোরে, তখন এটি একটি নির্দিষ্ট দিকে চলে। যদি কোনো গ্যালাক্সি পৃথিবীর গতির বিপরীত দিকে ঘোরে, তাহলে তার আলো সংকুচিত হয়ে উজ্জ্বলতর দেখাতে পারে। এই প্রভাবের কারণে পৃথিবী থেকে দেখা গ্যালাক্সিগুলোর ঘূর্ণনের দিকের মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে। যদি এই কারণেই পর্যবেক্ষণের মধ্যে এই পার্থক্য দেখা যায়, তাহলে আমাদের মহাবিশ্বের দূরত্ব পরিমাপ পুনরায় নির্ধারণ করতে হবে।

যদি আমাদের মহাবিশ্ব সত্যিই একটি বৃহত্তর ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে থাকে, তাহলে এর কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে:

  • মহাবিশ্বের সীমানা আসলে একটি ইভেন্ট হরাইজন হতে পারে, যার বাইরে কিছুই আমাদের কাছে দৃশ্যমান নয়।
  • মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ এবং মহাকর্ষীয় তরঙ্গের প্রকৃতি নতুনভাবে ব্যাখ্যা করতে হবে।
  • ব্ল্যাক হোলের কেন্দ্রে যা ঘটে, তা মহাবিশ্বের গঠন এবং ভবিষ্যত সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে পারে।

বর্তমানে ব্ল্যাক হোল মহাবিশ্বতত্ত্ব একটি আকর্ষণীয় কিন্তু বিতর্কিত তত্ত্ব। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে, আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে প্রচলিত অনেক বিশ্বাস পরিবর্তন করতে হবে। গবেষক লিওর শামির বলেছেন, “যদি এই পর্যবেক্ষণ সত্য হয়, তাহলে আমাদের দূরত্ব পরিমাপের পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এটি মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার এবং অতিপ্রাচীন গ্যালাক্সির অস্তিত্ব সম্পর্কে আমাদের বোঝাপড়া বদলে দিতে পারে।” সুতরাং, এই গবেষণার উপর ভিত্তি করে নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয় যে আমাদের মহাবিশ্ব সত্যিই একটি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে রয়েছে। তবে এটি একটি সম্ভাবনা, যা ভবিষ্যতে আরও গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নিশ্চিত করা যেতে পারে।

নাসার হাবল টেলিস্কোপ কুইপার বেল্টে নতুন গ্রহাণু আবিষ্কার

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো