জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ (JWST) নতুনভাবে ইতিহাস গড়েছে। এই দূরবীক্ষণ যন্ত্রটি মহাকাশের একটি ব্যতিক্রমী বিকৃতি কাজে লাগিয়ে ৬.৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরের একটি গ্যালাক্সির ৪৪টি পৃথক নক্ষত্র শনাক্ত করেছে। এটি এখন পর্যন্ত মহাবিশ্বের এত দূরে অবস্থিত নক্ষত্রগুলোর সর্বাধিক সংখ্যার পর্যবেক্ষণ।
এই অসাধারণ চিত্রটি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে JWST-এর উচ্চ রেজোলিউশনের অপটিক্স এবং অগ্রবর্তী গ্যালাক্সি ক্লাস্টার আবেল ৩৭০-এর মধ্য দিয়ে আসা আলোকে কাজে লাগিয়ে। আলোটি এই গ্যালাক্সি ক্লাস্টারের মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রে বিকৃত হয়ে এমনভাবে আমাদের কাছে পৌঁছায় যে এটি বহু দূরের নক্ষত্রগুলোর আলোক বিচ্ছুরণকে বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুনঃ নাসার পার্কার সোলার প্রোব সূর্যের বায়ু মন্ডলে প্রবেশ করে ইতিহাস গড়েছে
মহাকর্ষীয় লেন্সিং এই প্রক্রিয়াটি মহাকর্ষীয় লেন্সিং নামে পরিচিত। এটি এমন এক বিস্ময়কর প্রক্রিয়া যেখানে একটি বড় মহাকাশীয় বস্তুর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র পেছনের কোনো বস্তু থেকে আসা আলোকে বাঁকিয়ে দেয়। এতে আলো চক্রাকার আকারে বা ধনুকের মতো বক্ররেখায় পরিণত হয়, যেটিকে একত্রে “আইনস্টাইনের রিং” বলা হয়। বিখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এই প্রক্রিয়ার পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। এই ক্ষেত্রে “ড্রাগন আর্ক” নামে পরিচিত একটি ধনুক আকৃতির চিত্র দৃশ্যমান হয়েছে।
সম্প্রতি, ন্যাচার অ্যাস্ট্রোনমি জার্নালে একটি গবেষণা প্রবন্ধে এই আবিষ্কারের বিবরণ প্রকাশিত হয়েছে। হার্ভার্ড ও স্মিথসোনিয়ান’স সেন্টার ফর অ্যাস্ট্রোফিজিক্স-এর বিজ্ঞানীরা এই গবেষণা পরিচালনা করেছেন। একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে, এই আবিষ্কারকে চাঁদের উপর দূরবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে ধূলিকণার মতো ক্ষুদ্র কণাগুলো শনাক্ত করার সাথে তুলনা করা হয়েছে।
উল্লেখযোগ্য সাফল্য এই আবিষ্কারটি প্রমাণ করেছে যে দূরবর্তী গ্যালাক্সির পৃথক নক্ষত্রগুলোকে বিশদে অধ্যয়ন করা সম্ভব। গবেষণার সহ-লেখক এবং পোস্টডক্টোরাল গবেষক ফেংউ সান বলেন, “হাবল স্পেস টেলিস্কোপের মাধ্যমে যেখানে সাতটি নক্ষত্র শনাক্ত করা গিয়েছিল, সেখানে এখন JWST’র সাহায্যে আমরা বহুদূরের নক্ষত্রগুলো পর্যবেক্ষণ করতে পারছি। এটি আমাদের নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে।”
মহাবিশ্বের মধ্যবর্তী পর্যায়ের কোনো গ্যালাক্সিতে পৃথক নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করা অত্যন্ত বিরল। তবে এই সাফল্যের মাধ্যমে শুধুমাত্র নতুন রেকর্ড স্থাপন করা নয়, বরং বিজ্ঞানীরা আশা করছেন এই পর্যবেক্ষণ থেকে তারা আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে পারবেন। বিশেষ করে, এটি মহাবিশ্বের রহস্যময় ডার্ক ম্যাটার সম্পর্কে নতুন জ্ঞান সরবরাহ করতে পারে।
ডার্ক ম্যাটার এবং এর তাৎপর্য ডার্ক ম্যাটার এমন এক কাল্পনিক কণার সমষ্টি যা সরাসরি পর্যবেক্ষণ করা যায় না। এটি কোনো আলো শোষণ, প্রতিফলন বা নির্গমন করে না। বিজ্ঞানীদের মতে, ডার্ক ম্যাটার মহাবিশ্বের প্রায় ৮৫ শতাংশ ভর ধারণ করে। মহাকর্ষীয় লেন্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে আরও নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করলে ডার্ক ম্যাটার সম্বন্ধে নতুন তথ্য পাওয়া যেতে পারে। ফেংউ সান বলেন, “যেহেতু পূর্বে আমরা মাত্র কিছু নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করতে পেরেছিলাম, তাই এই নতুন পর্যবেক্ষণ আমাদের আরও ভালোভাবে ডার্ক ম্যাটার বোঝার সুযোগ দেবে।”
লাল দানব নক্ষত্র ড্রাগন আর্কের অধিকাংশ নক্ষত্র লাল দানব (রেড সুপারজায়ান্ট) প্রকারভুক্ত। এই ধরনের নক্ষত্রগুলোর উদাহরণ হলো ওরিয়নের বেতেলজুস এবং টরাসের আলডেবারান। সন্ধ্যার পর পূর্ব দিগন্তে এদের সহজেই খালি চোখে দেখা যায়।
JWST-এর ইনফ্রারেড আলোকসংবেদনশীলতা এই লাল দানব নক্ষত্রগুলো শনাক্ত করার ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে। ফেংউ সান বলেন, “আমাদের আঞ্চলিক গ্যালাক্সির লাল দানব নক্ষত্রগুলো সম্পর্কে আমরা অনেক বেশি জানি কারণ সেগুলো কাছাকাছি অবস্থান করছে। আমরা তাদের ছবি তুলতে পারি, স্পেকট্রা বিশ্লেষণ করতে পারি, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে তাদের পৃষ্ঠের বিশদও দেখতে পারি।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে আমরা দূরবর্তী মহাবিশ্বের লাল দানব নক্ষত্রগুলোর আচরণ এবং গ্যালাক্সি গঠনের প্রাথমিক পর্যায় সম্পর্কে আরও জানতে পারি।
ভবিষ্যৎ গবেষণার পরিকল্পনা JWST-এর এই মাইলফলক আবিষ্কারকে ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা ভবিষ্যতে আরও পর্যবেক্ষণ পরিচালনার পরিকল্পনা করছেন। ড্রাগন আর্ক গ্যালাক্সির নক্ষত্র এবং আরও দূরবর্তী গ্যালাক্সিগুলোর পর্যবেক্ষণ করা হবে। এই পর্যবেক্ষণ থেকে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের গঠনের প্রাথমিক পর্যায় এবং নক্ষত্রগুলোর বিবর্তন সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য আশা করছেন।
JWST-এর এই অসাধারণ সাফল্য শুধুমাত্র মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেনি, বরং মহাবিশ্বের গভীরতম রহস্যগুলো উদঘাটনের পথ সুগম করেছে। এর সাহায্যে আমরা আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে আরও গভীর এবং বিস্তৃত ধারণা অর্জন করতে পারব।
আরও পড়ুনঃ নাসা কেন মানুষকে এখন আর চাঁদে পাঠাচ্ছেনা ? কি এর রহস্য ?