চা পানের অভ্যাস আমাদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে, টি ব্যাগ থেকে নির্গত মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে। প্লাস্টিক দূষণ ইতিমধ্যেই একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে, এবং এটি পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের উপর গভীর প্রভাব ফেলছে। এই প্রবন্ধে টি ব্যাগ থেকে নির্গত মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস, পরিমাণ এবং মানব দেহে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে।
গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, টি ব্যাগের উপাদান হিসেবে ব্যবহৃত প্লাস্টিকের প্রধান ধরনের মধ্যে রয়েছে নাইলন-৬, পলিপ্রোপিলিন এবং সেলুলোজ। উষ্ণ পানিতে টি ব্যাগ ডুবানোর সময় বিপুল পরিমাণ ন্যানোমিটার-পর্যায়ের কণা এবং ফাইবারস সৃষ্টি হয়। উদাহরণস্বরূপ, পলিপ্রোপিলিন টি ব্যাগ প্রতি মিলিলিটারে প্রায় ১.২ বিলিয়ন কণা নির্গত করে, যার গড় আকার ১৩৬.৭ ন্যানোমিটার। সেলুলোজ টি ব্যাগ প্রতি মিলিলিটারে ১৩৫ মিলিয়ন কণা নির্গত করে এবং এর গড় আকার ২৪৪ ন্যানোমিটার। নাইলন-৬ টি ব্যাগ প্রতি মিলিলিটারে ৮.১৮ মিলিয়ন কণা নির্গত করে, যার গড় আকার ১৩৮.৪ ন্যানোমিটার।
আরও পড়ুনঃ মারাত্মক ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার অন্যতম বড় উৎস গাড়ির টায়ার
এই গবেষণাটি সম্পন্ন করেছেন মিউটাজেনেসিস গ্রুপের বিজ্ঞানীরা, যাঁরা স্পেনের বার্সেলোনা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিকস এবং মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের সাথে কাজ করেন। তারা অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করেন। ব্যবহার করা প্রযুক্তিগুলির মধ্যে ছিল স্ক্যানিং ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপি (SEM), ট্রান্সমিশন ইলেকট্রন মাইক্রোস্কপি (TEM), ইনফ্রারেড স্পেক্ট্রোস্কপি (ATR-FTIR), ডাইনামিক লাইট স্ক্যাটারিং (DLS), লেজার ডপলার ভেলোসিমেট্রি (LDV), এবং ন্যানোপার্টিকল ট্র্যাকিং অ্যানালাইসিস (NTA)। এই প্রযুক্তির সাহায্যে বিজ্ঞানীরা প্রথমবারের মতো মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক কণার আকার ও গঠন চিহ্নিত করতে সক্ষম হন।
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, এই মাইক্রোপ্লাস্টিক এবং ন্যানোপ্লাস্টিক কণা মানব অন্ত্রের কোষের সাথে আন্তঃক্রিয়া করতে সক্ষম। বিশেষ করে মিউকাস উৎপন্নকারী অন্ত্রের কোষগুলোর এই কণা গ্রহণের ক্ষমতা সর্বাধিক। আরও উদ্বেগজনক বিষয় হলো, কিছু কণা কোষের জিনগত উপাদান সংরক্ষণকারী নিউক্লিয়াসেও প্রবেশ করেছে। এটি মাইক্রোপ্লাস্টিকের দীর্ঘমেয়াদি স্বাস্থ্য প্রভাবের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি করেছে।
এই গবেষণার আলোকে বিজ্ঞানীরা কয়েকটি সুপারিশ প্রদান করেছেন। প্রথমত, প্লাস্টিক খাদ্য প্যাকেজিং এবং টি ব্যাগের মতো পণ্যগুলোর জন্য একটি মানসম্মত পরীক্ষার পদ্ধতি তৈরি করা প্রয়োজন। দ্বিতীয়ত, খাদ্য সুরক্ষা এবং জনস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে এই ধরনের পণ্যের ব্যবহার সীমিত করার জন্য কঠোর নিয়মনীতি প্রণয়ন করা উচিত।
টি ব্যাগ থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক নির্গমনের বিষয়টি কেবলমাত্র একটি ছোট উদাহরণ। প্লাস্টিক দূষণ একটি বৈশ্বিক সমস্যা যা পরিবেশ এবং মানবস্বাস্থ্যের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলতে পারে। খাদ্য ও পানীয় পণ্যে প্লাস্টিক উপাদান ব্যবহারের ব্যাপারে আমাদের সচেতন হওয়া উচিত। বিকল্প পণ্য যেমন জৈব উপাদান দিয়ে তৈরি টি ব্যাগ বা খোলা চা ব্যবহারের উপর জোর দেওয়া উচিত। এছাড়া, প্লাস্টিক দূষণ প্রতিরোধে পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং পরিবেশবান্ধব পণ্যের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা উচিত।
পরিশেষে, গবেষণার এই ফলাফল আমাদেরকে একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়: আমরা প্রতিদিনের অভ্যাস এবং খাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে অজান্তেই আমাদের শরীরে ক্ষতিকর কণা গ্রহণ করছি। এই বিষয়টি নিয়ে ব্যক্তিগত সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকার এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্যের সুরক্ষা এবং পরিবেশের উন্নতির জন্য একসঙ্গে কাজ করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
নতুন ধরণের প্লাস্টিক উপাদান যা একইসঙ্গে প্রসারণযোগ্য, নমনীয়, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং খরচ-সাশ্রয়ী