কম্পিউটার চিপের পৃষ্ঠে ট্রানজিস্টরের ঘনত্ব বৃদ্ধির প্রচেষ্টা প্রযুক্তি শিল্পে দীর্ঘদিন ধরে চলমান। তবে এটি একটি সীমায় এসে পৌঁছেছে। এজন্য চিপ নির্মাতারা একটি নতুন পদ্ধতির দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন, যেখানে চিপগুলোকে সমতলভাবে প্রসারিত করার পরিবর্তে উল্লম্বভাবে স্তূপীকৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এমআইটি ইঞ্জিনিয়াররা সম্প্রতি একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যা উচ্চতর ৩ডি চিপ তৈরির নতুন পথ দেখিয়েছে। এই পদ্ধতিটি সিলিকন ওয়েফারের প্রয়োজনীয়তা দূর করে সরাসরি মাল্টি-লেয়ার ট্রানজিস্টর তৈরি করতে সক্ষম।
বর্তমান চিপ নির্মাণে সিলিকন ওয়েফার ব্যবহার করা হয়, যা চিপ তৈরির প্রধান উপাদান হিসেবে কাজ করে। তবে প্রতিটি স্তরে সিলিকনের উপস্থিতি চিপের কার্যক্ষমতা সীমিত করে এবং স্তরগুলোর মধ্যে যোগাযোগের গতি কমিয়ে দেয়। অধিকন্তু, সিলিকন ওয়েফারের পুরুত্বের কারণে চিপের ওজন এবং আকার বৃদ্ধি পায়, যা ডিভাইসের মিনি-আকারকরণ বা ক্ষুদ্রাকরণে বাধা দেয়। সিলিকন ওয়েফার-নির্ভর প্রযুক্তি ব্যবহার করে ৩ডি চিপ নির্মাণে আরও একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিটি স্তরের মধ্যে যথাযথ সংযোগ স্থাপন। প্রচলিত পদ্ধতিতে, চিপের স্তরগুলোর মধ্যে সংযোগ তৈরি করতে ছোট গর্ত ড্রিল করা হয়, যা জটিল এবং ব্যয়বহুল। এই সীমাবদ্ধতাগুলোর কারণে চিপের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করার প্রচেষ্টা ধীরগতিতে অগ্রসর হচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার চিপ উন্নয়নের পথে আরো একটি সাফল্য অর্জন করেছে বিজ্ঞানীরা
এমআইটি ইঞ্জিনিয়াররা এই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করতে একটি নতুন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন যা সিলিকন ওয়েফার ছাড়াই মাল্টি-লেয়ার ট্রানজিস্টর তৈরি করতে সক্ষম। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মতো নিম্ন তাপমাত্রায় উচ্চ মানের একক-স্ফটিক ট্রানজিস্টর তৈরি করা সম্ভব। এই পদ্ধতিতে, প্রতিটি স্তর সরাসরি অন্য স্তরের উপর তৈরি হয়, যা স্তরগুলোর মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ এবং উন্নত কার্যক্ষমতা নিশ্চিত করে।
এই পদ্ধতি ধাতববিদ্যার একটি ধারণা থেকে অনুপ্রাণিত। যখন ধাতু একটি ছাঁচে ঢালা হয়, তখন এটি প্রান্ত থেকে ক্রিস্টালাইজেশন বা স্ফটিকায়ন শুরু করে। এই ধারণা কাজে লাগিয়ে এমআইটি গবেষকরা একটি সিলিকন ডাইঅক্সাইড মাস্ক তৈরি করেন যা “বীজ” বা ক্রিস্টালাইজেশনের সূচনাকারী কেন্দ্র সরবরাহ করে। এর মাধ্যমে নিম্ন তাপমাত্রায় একক-স্ফটিক ট্রানজিস্টর তৈরি করা সম্ভব হয়।
এই পদ্ধতিতে, গ্যাসের আকারে থাকা পরমাণুগুলো নির্দিষ্ট পকেটে স্থির হয় এবং সেখানে স্ফটিক গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। পকেটের প্রান্তগুলোতে পরমাণুর স্থাপন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়, যা তাপমাত্রা হ্রাস করার পরও কার্যকর থাকে। এর ফলে, নিম্ন তাপমাত্রায় একাধিক স্তরের ট্রানজিস্টর তৈরি করা সম্ভব হয়েছে।
গবেষণায় মোলিবডেনাম সালফাইড (MoS2) এবং টাংস্টেন ডাইসেলেনাইড (WSe2) এর মতো উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। এগুলো পি-টাইপ এবং এন-টাইপ ট্রানজিস্টরের জন্য আদর্শ, যা যেকোনো লজিক সার্কিটের মূল উপাদান। একাধিক স্তর একত্রিত করে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করে গবেষকরা একটি কার্যকরী ৩ডি চিপ তৈরি করেছেন।
পি-টাইপ এবং এন-টাইপ ট্রানজিস্টরের বিকল্প ব্যবহারের মাধ্যমে, লজিক এবং মেমরি উভয় কার্য সম্পাদনের জন্য একটি শক্তিশালী চিপ তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। এই পদ্ধতিতে তৈরি চিপগুলোর কার্যক্ষমতা প্রচলিত চিপগুলোর তুলনায় অনেক বেশি।
সিগেট বাজারে নিয়ে আসতে যাচ্ছে নতুন প্রযুক্তির এইচ.এ.এম.আর ড্রাইভ
এই পদ্ধতিটি শুধুমাত্র ৩ডি লজিক চিপ নয়, বরং ৩ডি মেমরি চিপ তৈরিতেও ব্যবহৃত হতে পারে। প্রচলিত ৩ডি চিপে সিলিকন ওয়েফার স্তরগুলোর মধ্যে থাকে, যা স্তর সংখ্যা এবং তাদের যোগাযোগ সীমিত করে। নতুন পদ্ধতিতে, একাধিক লেয়ার তৈরি করে চিপের কার্যক্ষমতা বাড়ানো সম্ভব। এছাড়া, এই পদ্ধতিটি এআই হার্ডওয়্যার এবং পরিধানযোগ্য ডিভাইসে ব্যবহারের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে। বর্তমান ডেটা সেন্টারের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর জন্যও এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
গবেষণা দলটি তাদের উদ্ভাবনকে বাণিজ্যিকীকরণের জন্য “FS2” নামে একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে। তাদের লক্ষ্য হলো এই পদ্ধতিকে বড় পরিসরে প্রয়োগ করা এবং পেশাদার এআই চিপের উৎপাদনে ব্যবহার করা। বাণিজ্যিকীকরণের ক্ষেত্রে, এই পদ্ধতিতে তৈরি চিপগুলোর কার্যক্ষমতা এবং দক্ষতা প্রমাণ করতে হবে। এটি কেবলমাত্র গবেষণাগারে সীমাবদ্ধ না রেখে বৃহৎ উৎপাদনে নিয়ে যাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
এমআইটি ইঞ্জিনিয়ারদের এই উদ্ভাবন আধুনিক চিপ প্রযুক্তিতে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। এটি কেবলমাত্র চিপের কার্যক্ষমতা বাড়াবে না, বরং ডিভাইসগুলোর ক্ষুদ্রাকরণ, উচ্চ গতিসম্পন্ন এআই হার্ডওয়্যার এবং ডেটা সেন্টারের কার্যক্ষমতা বাড়াতেও সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে, এই পদ্ধতি চিপ নির্মাণের প্রচলিত সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করে প্রযুক্তি শিল্পে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করতে পারে। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তৈরি চিপগুলো অতি দ্রুতগতির ডেটা প্রসেসিং এবং মেমরি স্টোরেজের জন্য উপযুক্ত হবে। পাশাপাশি, চিপ নির্মাণে সময় এবং খরচ উভয়ই হ্রাস পাবে। এমআইটি ইঞ্জিনিয়ারদের উদ্ভাবিত এই প্রযুক্তি আধুনিক কম্পিউটার বিজ্ঞান এবং ইলেকট্রনিক্সের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
আরও পড়ুনঃ নতুন কম্পিউটিং প্ল্যাটফর্ম যা একই সঙ্গে সেন্সিং এবং কম্পিউটিং কাজ করতে পারে