এমআরআই এর পূর্ণরূপ হলো Magnetic Resonance Imaging বাংলায় এর অর্থ হলো “চুম্বকীয় অনুরণন চিত্রায়ন।” এটি চুম্বকীয় শক্তি এবং রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে শরীরের ছবি তৈরি করে। এমআরআই (MRI) একটি আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে মানব শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিস্তারিত ছবি তোলা হয়। এটি এক ধরনের স্ক্যান, যা খুবই নির্ভুল এবং শরীরের ভেতরে কোনো অস্ত্রোপচার ছাড়াই বিভিন্ন সমস্যা শনাক্ত করতে পারে। এমআরআই মেশিন ১৯৭৭ সালে আবিষ্কার হয়। এর আবিষ্কারক হলেন রেমন্ড দ্যামাডিয়ান, যিনি এই প্রযুক্তি উদ্ভাবনের মাধ্যমে চিকিৎসাবিজ্ঞানে এক বিপ্লব ঘটান।
এমআরআই কেন করা হয় এবং এটি কি কি রোগ নির্ণয় করতে পারে?
ডাক্তাররা এমআরআই স্ক্যান করার পরামর্শ দেন শরীরের বিভিন্ন সমস্যার সঠিক কারণ খুঁজে বের করার জন্য। সাধারণত নিম্নলিখিত কারণগুলোর জন্য এমআরআই করা হয়:
- মস্তিষ্ক এবং মেরুদণ্ডের সমস্যাগুলি নির্ণয় করতে।
- হাড়, সন্ধি, এবং পেশির আঘাত বা অসুখ দেখতে।
- হার্ট এবং রক্তনালীর অবস্থা পরীক্ষা করতে।
- ক্যান্সার বা টিউমার শনাক্ত করতে।
- অভ্যন্তরীণ অঙ্গ যেমন লিভার, কিডনি, এবং ফুসফুসের সমস্যাগুলি বোঝার জন্য।
এমআরআই মেশিন কিভাবে কাজ করে?
এমআরআই মেশিনটি চুম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি করে এবং এটি রেডিও তরঙ্গ প্রেরণের মাধ্যমে কাজ করে। যখন এই তরঙ্গ শরীরে প্রবেশ করে, তখন দেহের হাইড্রোজেন পরমাণুগুলোর নিউক্লিয়াসে প্রতিক্রিয়া ঘটে। এই প্রতিক্রিয়ায় নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত সংকেত চুম্বকীয় তরঙ্গের সাথে যুক্ত হয়ে ফিরে আসে। মেশিনটি এই সংকেতগুলোকে সংগ্রহ করে এবং বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে ছবিতে রূপান্তরিত করে। এর ফলে শরীরের ভেতরের অঙ্গ এবং টিস্যুর অত্যন্ত স্পষ্ট ছবি পাওয়া যায়। এই প্রযুক্তির বিশেষত্ব হলো এটি রেডিয়েশনের পরিবর্তে চুম্বকীয় শক্তি ব্যবহার করে, যা শরীরের জন্য সম্পূর্ণ নিরাপদ। এমআরআই মেশিন নরম টিস্যু যেমন মস্তিষ্ক, হৃদযন্ত্র, মেরুদণ্ড এবং লিগামেন্টের ছবি তুলতে বিশেষভাবে কার্যকর। এমনকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র টিউমার বা স্নায়ুর জটিলতা নির্ণয়েও এটি অসাধারণ কাজ করে। এমআরআই করার সময় রোগীকে মেশিনের ভেতরে স্থির থাকতে হয়। মেশিনটি চারপাশে ঘুরে বিভিন্ন কোণ থেকে ছবি তোলে। এর সময় কিছু শব্দ হতে পারে, যা মেশিনের কাজের স্বাভাবিক অংশ। প্রয়োজনে কনট্রাস্ট ডাই ইনজেকশন ব্যবহার করা হয়, যা শরীরের বিশেষ অঙ্গ বা টিস্যুর ছবি আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করে।
এমআরআই করলে কি শরীরের কোনে ক্ষতি হয়?
এমআরআই সাধারণত সম্পূর্ণ নিরাপদ একটি পরীক্ষা, কারণ এতে ক্ষতিকারক রেডিয়েশন ব্যবহৃত হয় না। এটি চুম্বকীয় শক্তি এবং রেডিও তরঙ্গের সাহায্যে কাজ করে, যা শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ নয়। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে সামান্য অস্বস্তি বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে:
- কনট্রাস্ট ডাই ইনজেকশন: কিছু এমআরআই স্ক্যানে আরও স্পষ্ট ছবি পাওয়ার জন্য কনট্রাস্ট ডাই ব্যবহার করা হয়। এই ডাই সাধারণত নিরাপদ হলেও কারও কারও ক্ষেত্রে এটি অ্যালার্জি বা হালকা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। তবে এই সমস্যা খুবই বিরল।
- ক্লাস্ট্রোফোবিয়া: এমআরআই করার সময় রোগীকে একটি বন্ধ মেশিনের ভেতরে শুয়ে থাকতে হয়। যাদের ক্লাস্ট্রোফোবিয়া বা বন্ধ জায়গায় থাকার ভয় রয়েছে, তাদের জন্য এটি অস্বস্তিকর হতে পারে।
- চুম্বকীয় ক্ষেত্রের প্রভাব: যেসব রোগীর শরীরে ধাতব ইমপ্লান্ট, পেসমেকার, বা অন্য কোনো ধাতব যন্ত্রাংশ রয়েছে, তাদের জন্য এমআরআই মেশিন ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। তাই পরীক্ষার আগে ডাক্তারকে এ বিষয়ে জানানো জরুরি।
- গর্ভাবস্থা: যদিও এমআরআই সাধারণত গর্ভবতী নারীদের জন্য নিরাপদ, তবে প্রথম তিন মাসে এটি করার ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়। কারণ এই সময় ভ্রূণের বিকাশ প্রক্রিয়া সংবেদনশীল অবস্থায় থাকে।
এমআরআই করার সময় রোগীকে কোনো ধাতব জিনিসপত্র যেমন গহনা বা ঘড়ি খুলে ফেলতে হয়, কারণ এগুলো মেশিনের চুম্বকীয় শক্তির সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। এটি সম্পূর্ণ নিরাপদ, তাই সঠিক নির্দেশনা মেনে এটি করালে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না।
এমআরআই কিভাবে করা হয়?
১. প্রথমে রোগীকে বিশেষ পোশাক পরতে বলা হয়। ২. রোগীকে একটি সরু টেবিলে শোয়ানো হয়, যা মেশিনের ভেতরে ঢুকে যায়। ৩. মেশিনটি চারপাশে ঘুরতে থাকে এবং শব্দ করে। এই সময় রোগীকে নড়াচড়া না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। ৪. প্রয়োজনে ডাক্তার রোগীর রক্তে একটি বিশেষ রঙ বা কনট্রাস্ট ইনজেকশন করতে পারেন, যা স্ক্যানের ছবি আরও স্পষ্ট করতে সাহায্য করে।
সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই এর মধ্যে পার্থক্য
সিটি স্ক্যান (CT Scan) এবং এমআরআই স্ক্যান দুটোই গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা পদ্ধতি। তবে এগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে:
বিষয় | সিটি স্ক্যান | এমআরআই |
---|---|---|
পদ্ধতি | এক্স-রে রেডিয়েশন ব্যবহার করে | চুম্বকীয় ক্ষেত্র এবং রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার করে |
ছবি তোলা | হাড় এবং কঠিন টিস্যু ভালোভাবে দেখা যায় | নরম টিস্যু ও অঙ্গ স্পষ্টভাবে দেখা যায় |
সময় লাগে | কয়েক মিনিট | ৩০ মিনিট থেকে ১ ঘণ্টা বা তার বেশি |
রেডিয়েশন | হ্যাঁ, ক্ষুদ্র পরিমাণ রেডিয়েশন ব্যবহৃত হয় | না, কোনো রেডিয়েশন নেই |
খরচ | ২,০০০ টাকা থেকে ১৫,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। | ৫,০০০ টাকা থেকে ৩০,০০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে। |
এমআরআই একটি নিরাপদ, কার্যকর, এবং নির্ভুল চিকিৎসা পদ্ধতি। এটি ডাক্তারদের রোগ নির্ণয়ে অসাধারণ সাহায্য করে। সঠিক সময়ে এমআরআই করার মাধ্যমে অনেক গুরুতর রোগ দ্রুত শনাক্ত করা সম্ভব। সিটি স্ক্যান এবং এমআরআই দুটোই গুরুত্বপূর্ণ, তবে এমআরআই বিশেষত নরম টিস্যুর জন্য বেশি কার্যকর। তাই প্রয়োজন বুঝে ডাক্তারদের পরামর্শ অনুযায়ী এই পরীক্ষা করানো উচিত।