জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে আঘাতকারী উল্কাপিন্ডের রহস্যময় উত্স উন্মোচন করেছেন

বহু বছর ধরে মহাজাগতিক বস্তুর উৎসের বিষয়ে বিভিন্ন গবেষণা পরিচালিত হলেও অধিকাংশ উল্কাপিণ্ডের উৎস নিয়ে ছিল অনেক প্রশ্ন। তবে, সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন যে পৃথিবীতে পতিত ৭০% উল্কাপিণ্ডের উৎস মাত্র তিনটি প্রধান গ্রহাণু পরিবার। এই পরিবারগুলো মূলত কিছু সাম্প্রতিক মহাজাগতিক সংঘর্ষের ফলে গঠিত হয়েছে। এর মাধ্যমে পৃথিবীর অধিকাংশ উল্কাপিণ্ডের উৎস চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে।

সিএনআরএস (ফ্রান্স), ইউরোপীয় সাউদার্ন অবজারভেটরি (ESO) এবং চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়ের (চেক প্রজাতন্ত্র) একটি গবেষণা দল এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের নেতৃত্ব দিয়েছে। গবেষণায় উঠে এসেছে, মোট উল্কাপিণ্ডগুলোর মধ্যে ৭০% তিনটি গ্রহাণু পরিবারের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারগুলো হলো কারিন, কোরোনিস এবং মাসালিয়া, যা যথাক্রমে ৫.৮, ৭.৫ এবং প্রায় ৪০ মিলিয়ন বছর আগে সংঘর্ষের ফলে গঠিত হয়েছে।

এই গবেষণাটি ২০২৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর “Astronomy and Astrophysics” জার্নালে প্রকাশিত হয়, এবং নতুন দুটি গবেষণাপত্র ২০২৪ সালের ১৬ অক্টোবর “Nature” জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ৯০% এর বেশি উল্কাপিণ্ডের উৎস নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এর ফলে পৃথিবীতে পতিত অধিকাংশ উল্কাপিণ্ডের উৎস স্পষ্ট হয়েছে এবং গ্রহাণু পরিবারগুলোর বিবর্তন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেছে।

আরও পড়ুনঃ নাসা চাঁদের মিশনে গুরুত্বপূর্ণ সমস্যার সমাধানে ৩ মিলিয়ন ডলার পুরস্কারের ঘোষণা করেছে

গবেষণায় দেখা গেছে, মাসালিয়া পরিবারটি পৃথিবীতে পাওয়া ৩৭% উল্কাপিণ্ডের জন্য দায়ী। এই পরিবারটি প্রায় ৪০ মিলিয়ন বছর আগে সংঘর্ষের মাধ্যমে তৈরি হয়েছিল। অন্যদিকে, কারিন এবং কোরোনিস পরিবার দুটি পৃথিবীতে পাওয়া ৩৩% উল্কাপিণ্ডের উৎস। এই পরিবারগুলো থেকে আসা উল্কাপিণ্ডগুলো “H চন্ড্রাইট” নামে পরিচিত।

অন্যদিকে, ৮% উল্কাপিণ্ড ফ্লোরা এবং নায়সা নামের দুটি গ্রহাণু পরিবারের উৎস থেকে আসে। এছাড়া, বৃহৎ গ্রহাণু ভেস্টা থেকে প্রাপ্ত উল্কাপিণ্ডের হার ৬%। তবে পূর্বের গবেষণায় দেখা গেছে, মাত্র ১% এরও কম উল্কাপিণ্ড মঙ্গল এবং চাঁদ থেকে এসেছে।

গবেষণা অনুযায়ী, নতুন গঠিত গ্রহাণু পরিবারগুলোতে অনেক বেশি ছোট ছোট টুকরা থাকে যা সংঘর্ষের ঝুঁকি বাড়ায়। এই ফ্রাগমেন্টগুলোর চলাচল বেশি হওয়ার কারণে তারা গ্রহাণু বেল্ট থেকে বেরিয়ে এসে পৃথিবীর দিকে ছুটে আসে। অন্যদিকে, পুরনো গ্রহাণু পরিবারগুলোতে এসব ছোট ফ্রাগমেন্টগুলো সংঘর্ষ এবং বিবর্তনের কারণে হারিয়ে যায়। ফলে, কারিন, কোরোনিস, এবং মাসালিয়া থেকে এত বেশি সংখ্যক উল্কাপিণ্ড পাওয়া যায়, যা পুরোনো গ্রহাণু পরিবারগুলোর ক্ষেত্রে আর সম্ভব হয় না।

এখনো পৃথিবীতে পাওয়া ১০% উল্কাপিণ্ডের উৎস চিহ্নিত করা যায়নি। এই রহস্য উদঘাটনে গবেষক দলটি ভবিষ্যতে নতুন গ্রহাণু পরিবারগুলোর ওপর গবেষণা করতে চায়, বিশেষত যারা ৫০ মিলিয়ন বছরের কম সময়ে গঠিত হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে পৃথিবীতে পতিত উল্কাপিণ্ডগুলোর সাথে বৃহত্তর মহাকাশীয় ঘটনা এবং সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ হুমকির পূর্বাভাস দেওয়া সম্ভব হতে পারে।

নতুন মহাকাশ ভিত্তিক সৌর শক্তি স্টার্টআপ “এথারফ্লাক্স”

উল্কাপিণ্ডের গবেষণা শুধু এর উৎস নয়, বরং মহাজাগতিক ইতিহাস সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দেয়। এরা সূর্যের গঠনের সময় থেকে বেঁচে থাকা মূল উপাদান। কার্বনেসিয়াস চন্ড্রাইটস এবং আখন্ড্রাইটস জাতীয় উল্কাপিণ্ডগুলো মূলত প্রোটোপ্ল্যানেটারি ডিস্কের ধ্বংসাবশেষ হিসেবে বিবেচিত হয়। এগুলো পৃথিবীর প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দেয় এবং সৌরজগতের গঠনের সময়কালের বিবর্তন সম্পর্কে আলোকপাত করে।

বিজ্ঞানীরা এখন পৃথিবীর জন্য বিপজ্জনক আকারের গ্রহাণুদের সম্পর্কে গবেষণা করছেন। এই আকারের গ্রহাণুগুলো, যেমন রিউগু এবং বেন্নু, সাম্প্রতিক মহাকাশ মিশনের (Hayabusa2 এবং OSIRIS-REx) অংশ হিসেবে পরীক্ষিত হয়েছে। মহাকাশ মিশনের মাধ্যমে এগুলোর নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে এবং বর্তমানে ল্যাবরেটরিতে গবেষণা করা হচ্ছে।

আরো পড়ুন: নিউজিল্যান্ডের বিজ্ঞানীরা প্রশান্ত মহাসাগরের গভীরে নতুন ‘GHOST SHARK’ আবিষ্কার করেছেন

Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো