নাসার পার্কার সোলার প্রোব মানব ইতিহাসের একটি উল্লেখযোগ্য মাইলফলক অর্জন করেছে। এটি প্রথমবারের মতো সূর্যের এত কাছাকাছি পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছে, যেখানে আগে কোনো মানব-নির্মিত বস্তু পৌঁছাতে পারেনি। এই মহাকাশযানটি ২০২৪ সালের ২৪শে ডিসেম্বর মাত্র ৩.৮ মিলিয়ন মাইল (৬.১ মিলিয়ন কিলোমিটার) দূর থেকে সূর্যের উপরিভাগ বা করোনা অতিক্রম করেছে। এর মাধ্যমে এখন সূর্য সম্পর্কে আরো গভীর তথ্য সংগ্রহ করা যাবে।
এই মিশনের মূল লক্ষ্য হল সূর্যের কার্যক্রম সম্পর্কে আরও গভীর জ্ঞান অর্জন করা। পার্কার সোলার প্রোব এমন এলাকায় প্রবেশ করেছে যেখানে সূর্যের উপাদান গরম হয়ে কয়েক মিলিয়ন ডিগ্রি তাপমাত্রা অর্জন করে। এই অধ্যয়ন বিজ্ঞানীদের সাহায্য করবে সূর্যের উপকরণ কীভাবে উত্তপ্ত হয় এবং কীভাবে শক্তিশালী সৌর বায়ু সৃষ্টি হয় তা বোঝার জন্য। সৌর বায়ু হলো সূর্য থেকে অবিরত নির্গত হওয়া কণার প্রবাহ যা আমাদের সৌরজগতকে প্রভাবিত করে।
আরও পড়ুনঃ নাসা এবং আইএসআরও য়ৌথভাবে ২০২৫ সালে লঞ্চ করবে নিসার উপগ্রহ
নাসা জানিয়েছে যে, ২৪শে ডিসেম্বরের এই ঐতিহাসিক ফ্লাইবাইয়ের পর মহাকাশযানটি “নিরাপদ” অবস্থায় রয়েছে এবং স্বাভাবিকভাবে কাজ করছে। মিশন অপারেশন টিম, যা যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডে জনস হপকিন্স অ্যাপ্লাইড ফিজিক্স ল্যাবরেটরিতে অবস্থিত, ২৮শে ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার রাতের দিকে প্রোব থেকে একটি সিগন্যাল পেয়েছে। এই সিগন্যাল নিশ্চিত করে যে মহাকাশযানটি সফলভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই মিশনের একটি বড় বৈশিষ্ট্য হলো মহাকাশযানটির গতি। এটি প্রতি ঘণ্টায় ৪৩০,০০০ মাইল (প্রায় ৬৯২,০০০ কিলোমিটার) গতিতে চলেছে, যা এখন পর্যন্ত মানব-নির্মিত কোনো বস্তুর সর্বোচ্চ গতি। এত দ্রুতগতির পরও মহাকাশযানটি প্রায় ১,৮০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৯৮২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রা সহ্য করতে পেরেছে। মহাকাশযানটির বিশেষ কার্বন-ফোম শিল্ড এর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল এর তাপ-সহ্য করার ক্ষমতা। এটি সূর্যের করোনার প্রচণ্ড তাপমাত্রা, যা প্রায় ১,৮০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট (৯৮২ ডিগ্রি সেলসিয়াস) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে, সহ্য করে মহাকাশযানটিকে সুরক্ষিত রাখে। এই শিল্ড প্রায় ২,৬০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত তাপ সহ্য করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যা মিশনটির সাফল্যের মূল কারণ।
নাসার হেলিওফিজিক্স ডিরেক্টর ড. জোসেফ ওয়েস্টলেক বলেছেন, “আমরা সূর্য কীভাবে কাজ করে তা বোঝার জন্য নতুন তথ্য সংগ্রহ করছি। এই মিশন আমাদের বইপত্রের তথ্য পুনর্লিখন করতে সাহায্য করবে।” তিনি আরও যোগ করেন যে, “১৯৫০-এর দশকে এই মিশনের ধারণা দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু প্রযুক্তির সীমাবদ্ধতার কারণে এটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। বর্তমানে আমরা এমন উন্নত প্রযুক্তি তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি, যা আমাদেরকে সূর্যের গভীরে প্রবেশ করে এর কার্যপ্রক্রিয়া সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহের সুযোগ করে দিচ্ছে। এই প্রযুক্তি সূর্যের গহীনের তীব্র তাপ ও পরিবেশ সহ্য করার মতো শক্তিশালী, যা মহাজাগতিক গবেষণায় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে।”
পার্কার সোলার প্রোব ২০১৮ সালে উৎক্ষেপণ করা হয়। নাসার সায়েন্স মিশন ডিরেক্টরেটের প্রধান নিকি ফক্স বলেছেন, “সূর্যের এত কাছে উড়ে যাওয়া মানবতার জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।” তিনি আরও বলেন, “এই মিশনের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য আমাদের সৌরজগত এবং এর বাইরের পরিবেশ সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুন মাত্রায় উন্নীত করবে।” এই মিশনের অন্যতম বড় উদ্দেশ্য হল সৌর বায়ুর উৎপত্তি এবং এর ত্বরাণ্বিত হওয়ার কারণ খুঁজে বের করা। সৌর বায়ু হলো সূর্য থেকে নির্গত চার্জযুক্ত কণার একটি অবিরাম প্রবাহ, যা পৃথিবীর আবহাওয়া ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। এই প্রবাহের গতিপ্রকৃতি এবং শক্তি বুঝতে পারলে বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক ঝড় এবং অন্যান্য মহাকাশীয় বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিতে পারবেন।
সূর্য কী পদার্থ দিয়ে গঠিত? এবং এর অভ্যন্তরে কী প্রক্রিয়া চলে?
পার্কার সোলার প্রোবের এই সাফল্য আমাদের মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছে। এটি সূর্যের কার্যকলাপ এবং এর প্রভাব সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে পরিবর্তন করবে। মিশনের এই নতুন পর্যায়ে, বিজ্ঞানীরা আশা করছেন আরও অনন্য ঘটনা ক্যাপচার করতে। এই তথ্য ভবিষ্যতে মহাকাশ প্রযুক্তি এবং মহাকাশ পরিবেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
মিশনের পরবর্তী ধাপে মহাকাশযানটি সূর্যের আরও কাছাকাছি যাবে এবং সূর্যের কার্যপ্রণালী সম্পর্কে আরও বিশদ তথ্য সংগ্রহ করবে। এই তথ্য ২০২৫ সালে প্রকাশিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা মহাকাশ বিজ্ঞানীদের সূর্যের কার্যকলাপ আরও ভালোভাবে বিশ্লেষণ করতে সহায়তা করবে। তখন পর্যন্ত পার্কার সোলার প্রোব আমাদের সৌরজগত সম্পর্কে আরও চমকপ্রদ তথ্য প্রদান করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
২০২৬ সালে নাসা চাঁদে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্যে ওরিয়ন ক্যাপসুলের পুনঃ ডিজাইন করছে