কার্বন ন্যানোটিউব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ক্ষেত্রে নতুন এক সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছে, যেখানে এই উপাদান লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির চেয়েও তিনগুণ বেশি শক্তি সংরক্ষণ করতে সক্ষম। গবেষণায় দেখা গেছে, কার্বন ন্যানোটিউবের বিশেষ গঠন এবং বৈশিষ্ট্য এনার্জি স্টোরেজের ক্ষেত্রে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করতে পারে। এই উদ্ভাবন ভবিষ্যতে হালকা, সুরক্ষিত এবং উন্নত প্রযুক্তির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হতে পারে।
সম্প্রতি একটি বৈশ্বিক গবেষণা দলের নেতৃত্বে, যা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অফ মেরিল্যান্ড বাল্টিমোর কাউন্টি (UMBC) এর অ্যাডভান্সড সেন্সর টেকনোলজি সেন্টার (CAST)-এর দুই গবেষকসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান নিয়ে গঠিত, কার্বন ন্যানোটিউবের উপর ভিত্তি করে নতুন শক্তি সংরক্ষণ প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ঘোষণা দেয়। এই গবেষণার ফলাফল “ন্যাচার ন্যানোটেকনোলজি” জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
গবেষক দল এক প্রকারের কার্বন ন্যানোটিউব নিয়ে কাজ করেছে, যাকে বলা হয় সিঙ্গল-ওয়াল কার্বন ন্যানোটিউব। এটি খুবই পাতলা এবং বিশুদ্ধ কার্বনের একটি স্তর দিয়ে তৈরি। এর গঠন অনেকটা এক অণু পুরু কার্বন শিটের মতো, যা লম্বা এবং ক্ষুদ্র স্ট্র-এর মতো। কার্বন ন্যানোটিউব খুবই হালকা, শক্তিশালী এবং সহজে প্রস্তুত করা যায়। এটি স্টিলের তুলনায় ১০০ গুণ বেশি শক্তিশালী, যা ভবিষ্যতের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, যেমন স্পেস এলিভেটর, তৈরির ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ মানুষের মস্তিষ্কে সংখ্যা প্রক্রিয়াকরণের সঠিক স্থান নির্ণয় করেছেন বিজ্ঞানীরা
গবেষণায় দেখা গেছে, কার্বন ন্যানোটিউব থেকে তৈরি করা “রোপ” বা দড়ি আকৃতির উপাদান অত্যন্ত দক্ষতার সাথে শক্তি সংরক্ষণ করতে পারে। গবেষক দল বান্ডিল আকৃতির কার্বন ন্যানোটিউবগুলোকে একত্রে পেঁচিয়ে এক ধরণের রশি তৈরি করে। এরপরে সেই রশিগুলোতে বিভিন্ন পদার্থের প্রলেপ দেওয়া হয়, যাতে এটি আরও মজবুত এবং নমনীয় হয়। পরীক্ষার সময় দেখা যায়, এই রশিগুলো ১৫,০০০ গুণ বেশি শক্তি সংরক্ষণ করতে পারে স্টিলের স্প্রিংয়ের তুলনায় এবং লিথিয়াম-আয়ন ব্যাটারির তুলনায় তিনগুণ বেশি শক্তি সঞ্চয় করতে সক্ষম।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই শক্তি সংরক্ষণ ব্যবস্থা তাপমাত্রার পরিবর্তনে স্থায়ী থাকে। অর্থাৎ, -৬০°C থেকে +১০০°C (-৭৬°F থেকে +২১২°F) পর্যন্ত তাপমাত্রায় এই রশিগুলোর সংরক্ষিত শক্তি প্রায় অপরিবর্তিত থাকে। এই উপাদানগুলো মানব শরীরের জন্যও নিরাপদ, যা লিথিয়াম ব্যাটারির তুলনায় একটি বড় সুবিধা। উদাহরণস্বরূপ, মেডিক্যাল ইমপ্লান্ট বা সেন্সরের মতো ডিভাইসে এই প্রযুক্তি নিরাপদ এবং কার্যকরী শক্তি সরবরাহ করতে পারে।
এই গবেষণার অন্যতম প্রধান গবেষক এবং CAST-এর বিজ্ঞানী সঞ্জীব কুমার উজ্জয়ন বলেন, “মানুষ বহুদিন ধরে বিভিন্ন যান্ত্রিক স্প্রিংয়ে শক্তি সংরক্ষণ করে আসছে, যা ঘড়ি এবং খেলনার মতো সরঞ্জামে ব্যবহৃত হয়। আমাদের গবেষণা প্রমাণ করে যে, পেঁচানো কার্বন ন্যানোটিউব শক্তি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে একটি বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করেছে।” তিনি আরও জানান যে, CAST ইতোমধ্যে একটি প্রোটোটাইপ সেন্সরের জন্য এই কার্বন ন্যানোটিউবকে শক্তি উৎস হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার কাজ করছে।
কার্বন ন্যানোটিউবের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো এর উৎপাদন প্রক্রিয়া। গবেষণা দেখিয়েছে যে, বাণিজ্যিকভাবে পাওয়া যায় এমন কার্বন ন্যানোটিউব সহজেই ব্যবহার করা যায় এবং তা থেকে উন্নত উপাদান তৈরি করা সম্ভব। এভাবে উৎপাদন খরচ কমানো এবং প্রযুক্তির বিস্তৃত ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। তবে, এই প্রযুক্তি এখনও পুরোপুরি পরিপূর্ণ নয়। গবেষণার সময় দেখা গেছে যে, কিছু ক্ষেত্রে মানুষের শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো জটিল গঠন তৈরি করা প্রযুক্তির জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। তবে, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচনা, যা ভবিষ্যতে আরও উন্নত হবে বলে আশা করা যায়।
এই উদ্ভাবনের মাধ্যমে হালকা এবং শক্তিশালী ডিভাইস তৈরির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে, যা আধুনিক প্রযুক্তির অনেক ক্ষেত্রেই ব্যবহার করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, পরিধানযোগ্য সেন্সর, মেডিক্যাল ডিভাইস, খেলনা এবং অন্যান্য ডিভাইসে এটি ব্যবহার করা যেতে পারে। একই সাথে, এর নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব বৈশিষ্ট্য এটিকে আরও জনপ্রিয় করে তুলবে। কার্বন ন্যানোটিউব নিয়ে এই গবেষণা ভবিষ্যতে শক্তি সংরক্ষণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এটি প্রযুক্তির উন্নয়নে একটি বড় ধাপ এবং বিজ্ঞানীদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। যদি এই প্রযুক্তি আরও পরিশীলিত করা যায়, তাহলে এটি বিশ্বজুড়ে শক্তি সংরক্ষণ এবং ব্যবহারের পদ্ধতিকে আমূল পরিবর্তন করে দিতে পারে।
তথ্য সূত্রঃ সাইটেকডেইলি
স্পর্শ ছাড়ায় বস্তু স্থানান্তর করা যাবে কিরিগামি ডিজাইন এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করে