ডার্ক এনার্জির নতুন তথ্য মহাবিশ্বের মডেলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে

গত ডিসেম্বর, মেক্সিকোর কানকুন শহরের এক সম্মেলনে বিজ্ঞানী শেশাদ্রি নাদাথুর মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ নিয়ে একটি নতুন তথ্যচিত্র প্রকাশ করেন। এই তথ্য দেখে উপস্থিত বিজ্ঞানীরা বিস্মিত হয়ে যান, কারণ এটি আমাদের প্রচলিত মহাজাগতিক তত্ত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। নাদাথুরের মতে, এটি গত ২৫ বছরে মহাজাগতিক গবেষণায় সবচেয়ে বড় আবিষ্কারগুলোর একটি।

গত তিন দশক ধরে বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত প্রসারিত হচ্ছে এবং এর সম্প্রসারণের হার সময়ের সাথে একই থাকে। এই প্রসারণের পেছনে একটি রহস্যময় শক্তি কাজ করছে, যা “ডার্ক এনার্জি” নামে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের ধারণা, মহাবিশ্বের মোট উপাদানের প্রায় ৭০% অংশই এই ডার্ক এনার্জি নিয়ে গঠিত।

কিন্তু সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ডার্ক এনার্জির প্রভাব হয়তো সবসময় এক রকম থাকছে না। গত এপ্রিল মাসে “ডার্ক এনার্জি স্পেকট্রোস্কোপিক ইন্সট্রুমেন্ট” (DESI) পরিচালিত একটি গবেষণায় ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, ডার্ক এনার্জি সময়ের সাথে পরিবর্তিত হতে পারে। এবার, নতুন গবেষণা সেই ধারণাকে আরও শক্তিশালী করেছে, যা মহাবিশ্বের প্রচলিত মডেলকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

প্রায় এক শতাব্দী আগে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেন যে মহাবিশ্ব ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে। বিগ ব্যাং বা মহাবিস্ফোরণের পর থেকেই এটি চলমান রয়েছে। ১৯৯৮ সালে বিজ্ঞানীরা পর্যবেক্ষণ করেন যে মহাবিশ্বের প্রসারণ শুধু ঘটছে না, বরং এটি সময়ের সাথে আরও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। এটি বোঝার জন্য বিজ্ঞানীরা মহাজাগতিক সুপারনোভার (নক্ষত্র বিস্ফোরণ) আলো পর্যবেক্ষণ করেন এবং দেখতে পান, যত দূরের বস্তু, তারা তত দ্রুত আমাদের থেকে সরে যাচ্ছে।

এই পর্যবেক্ষণের ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানীরা “ডার্ক এনার্জি” ধারণা তৈরি করেন, যা মহাবিশ্বকে প্রসারিত করে চলেছে। এটি মহাকর্ষের বিপরীতে কাজ করে, অর্থাৎ যেখানে মহাকর্ষ বস্তুদের কাছে টানার চেষ্টা করে, সেখানে ডার্ক এনার্জি সবকিছুকে দূরে ঠেলে দেয়। কিন্তু এতদিন ধরে বিজ্ঞানীরা ধরে নিয়েছিলেন যে ডার্ক এনার্জির প্রভাব সময়ের সাথে একই থাকবে।

DESI প্রকল্পের বিজ্ঞানীরা লক্ষাধিক গ্যালাক্সির অবস্থান বিশ্লেষণ করেছেন এবং তাদের নতুন গবেষণা বলছে, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার একসময় বেশি ছিল এবং পরবর্তী সময়ে তা কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে।

এই গবেষণার জন্য তারা “ব্যারিওনিক অ্যাকোস্টিক অসিলেশন” (BAO) নামে পরিচিত এক ধরনের মহাজাগতিক তরঙ্গ বিশ্লেষণ করেছেন। বিগ ব্যাং-এর পর মহাবিশ্ব ছিল গরম গ্যাসের সমুদ্র, যেখানে বিশাল তরঙ্গ বা স্পন্দন তৈরি হয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে এই তরঙ্গগুলো স্থির হয়ে যায় এবং গ্যালাক্সির বিন্যাসে তার প্রভাব পড়ে। আজকের দিনে বিজ্ঞানীরা এই তরঙ্গগুলোর মাপজোখ করেই মহাবিশ্বের সম্প্রসারণ হার বোঝার চেষ্টা করেন।

এই নতুন গবেষণায় DESI গবেষকরা লক্ষ করেছেন যে, মহাবিশ্বের সম্প্রসারণের হার পূর্বের অনুমানের তুলনায় কিছুটা আলাদা। পরিমাপ অনুযায়ী, ডার্ক এনার্জির প্রভাব সময়ের সাথে পরিবর্তিত হচ্ছে। যদিও এই পরিবর্তন এখনো খুব বেশি স্পষ্ট নয়, তবে এটি প্রচলিত মহাজাগতিক মডেলের ভিত্তিকে নাড়িয়ে দিয়েছে।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, এই নতুন তথ্য আমাদের মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নতুন করে চিন্তা করতে বাধ্য করছে। যদি ডার্ক এনার্জির প্রভাব সময়ের সাথে বাড়তে থাকে, তবে একসময় এটি সমস্ত কিছুকে একে অপরের থেকে আলাদা করে দেবে, এমনকি পরমাণুগুলোকেও ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে পারে। আবার, যদি এটি দুর্বল হয়ে যায়, তবে মহাবিশ্ব হয়তো আবার সংকুচিত হতে পারে।

এই গবেষণা এখনো চূড়ান্ত নয়, কারণ বিজ্ঞানীরা সাধারণত কোনো বিষয়কে নিশ্চিত করার জন্য আরও পরীক্ষা চালান। যদিও DESI-এর গবেষণা ডার্ক এনার্জির পরিবর্তনশীলতা সম্পর্কে ৯৯.৯৯৭% নির্ভরযোগ্যতা দেখিয়েছে, তবে এটি আনুষ্ঠানিকভাবে “আবিষ্কার” হিসাবে স্বীকৃত হতে হলে আরও গবেষণার প্রয়োজন।

আগামী বছরগুলোতে মহাকাশ গবেষণার আরও নতুন প্রকল্প, যেমন ইউক্লিড স্যাটেলাইট এবং ভেরা সি. রুবিন অবজারভেটরি, এই গবেষণাকে সমর্থন বা চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে। বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে এই গবেষণা মহাজাগতিক বিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদের আরও গভীর ধারণা দেবে।

মহাবিশ্বের ইতিহাস ও ভবিষ্যৎ নিয়ে বিজ্ঞানীদের প্রচলিত ধারণা আজ প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ডার্ক এনার্জি কি সত্যিই সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয়? যদি হয়, তাহলে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী হবে? বিজ্ঞানীরা এখনো নিশ্চিত নন, তবে তারা জানেন যে এই গবেষণা মহাকাশ বিজ্ঞানের একটি নতুন যুগের সূচনা করেছে।

আমাদের মহাবিশ্ব কি ব্ল্যাক হোলের অভ্যন্তরে? নাসার জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপের নতুন তথ্য

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো