নতুন মোবাইল কেনার আগে যে ১০টি বিষয় জানা খুবি প্রয়োজন

বর্তমান যুগে মোবাইল ফোন আমাদের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। বাজারে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন মডেলের মোবাইল ফোন আসছে, যার ফলে সঠিক মোবাইলটি বেছে নেওয়া অনেক সময় কঠিন হয়ে যায়। নতুন মোবাইল কেনার সময় অনেকগুলো বিষয় বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আপনার কেনা ডিভাইসটি দীর্ঘদিন চলে এবং আপনার সঠিক চাহিদা পূরণ করতে পারে। আজ আমরা তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ১০টি বিষয় সম্পর্কে জানবো:-

১। বাজেট নির্ধারণ

প্রথমেই ঠিক করুন আপনি কত টাকা খরচ করতে পারবেন। মোবাইলের দাম হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকার মধ্যেও আছে। বাজেট অনুযায়ী ফোন বাছাই করুন। মনে রাখবেন, দামি ফোন মানেই সবচেয়ে ভালো ফোন নয়। আপনার প্রয়োজন অনুসারে সঠিক ফোনটি বেছে নিন। মোবাইলে সাধারণত ৩টি বাজেট রেঞ্জ ফোন আছে- ১। বাজেট ফোন, ২। মিড-রেঞ্জ ফোন এবং ৩। ফ্ল্যাগশিপ বা প্রিমিয়াম ফোন।

  • বাজেট ফোন (১০,০০০ – ২০,০০০ ) টাকা: যারা সাধারণ কাজ যেমন কল করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার এবং হালকা গেমিং করতে চান তাদের জন্য উপযুক্ত।
  • মিড-রেঞ্জ ফোন (২০,০০০ – ৫০,০০০ ) টাকা: যারা ভালো ক্যামেরা, মাল্টিটাস্কিং, গেমিং এবং উন্নত পারফরম্যান্স চান তাদের জন্য ভালো পছন্দ।
  • ফ্ল্যাগশিপ বা প্রিমিয়াম ফোন (৫০,০০০+ ) টাকা: যারা সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স, প্রিমিয়াম ডিজাইন, সেরা ক্যামেরা এবং লং-টার্ম সফটওয়্যার আপডেট চান তাদের জন্য উপযুক্ত এটি।

২। প্রসেসর

একটি মোবাইলের ৫০%-৬০% পারফরম্যান্স নির্ভর করে তার প্রসেসরের উপর আর বাকি ৪০% নির্ভর করে অন্যান্য যেমন, র‌্যাম, জিপিইউ, সফটওয়্যার ইত্যাদি। আপনি যদি গেমিং বা হাই-টাস্ক করতে চান, তাহলে শক্তিশালী প্রসেসর নির্বাচন করা আপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে কোয়ালকম স্ন্যাপড্রাগন (Qualcomm Snapdragon) ৭ এবং ৮ সিরিজের প্রসেসর উন্নত পারফরম্যান্স দেয়, মিডিয়াটেক ডাইমেনসিটি (MediaTek Dimensity) সিরিজও ভালো বিকল্প হতে পারে। আইফোন ব্যবহারকারীদের জন্য অ্যাপল এ সিরিজের প্রসেসর সর্বোচ্চ পারফরম্যান্স প্রদান করে।

৩। র‌্যাম ও স্টোরেজ

র‌্যাম (RAM) এবং স্টোরেজ (Storage) মোবাইলের গতি ও তথ্য সংরক্ষণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ৪জিবি বা ৬জিবি র‌্যাম সাধারণ ব্যবহার যেমন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্রাউজিং, কল করা ও হালকা অ্যাপ ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট। ৮জিবি বা ১২জিবি র‌্যাম মাল্টিটাস্কিং ও হেভি গেমিংয়ের জন্য ভালো। স্টোরেজের ক্ষেত্রে, ৬৪জিবি স্টোরেজ সাধারণ ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট হলেও, অধিক অ্যাপ ও মিডিয়া ফাইল সংরক্ষণের জন্য ১২৮জিবি বা তার বেশি স্টোরেজ নেওয়া ভালো। যদি প্রচুর ভিডিও ধারণ বা বড় ফাইল সংরক্ষণ করতে হয়, তাহলে ২৫৬জিবি বা তার বেশি স্টোরেজের ফোন বেছে নেওয়া উচিত।

মোবাইলে গেম খেলার সেরা সেটআপ এবং কনফিগারেশন যা আপনার গেম খেলার অভিজ্ঞতাকে নেক্সট লেভেলে নিয়ে যাবে

৪। ডিসপ্লে

মোবাইলের ডিসপ্লে হলো ফোনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যা ব্যবহারকারীর অভিজ্ঞতাকে সরাসরি প্রভাবিত করে। সাধারণত এটি দুই ধরনের হয়। এলসিডি ও ওএলইডি/অ্যামোলেড। এলসিডি তুলনামূলক সস্তা ও ব্যাটারি সাশ্রয়ী, তবে কালো রঙ কম গভীর দেখায়, কারণ এতে ব্যাকলাইট সবসময় সক্রিয় থাকে। অন্যদিকে, ওএলইডি বা অ্যামোলেড ডিসপ্লেতে প্রতিটি পিক্সেল আলাদাভাবে আলো দেয়, ফলে কালো রঙ পারফেক্ট হয় এবং কন্ট্রাস্ট বেশি থাকে। এলটিপিও ওএলইডি প্রযুক্তি থাকলে রিফ্রেশ রেট ১ থেকে ১২০ হার্জ পর্যন্ত পরিবর্তন হতে পারে, যা ব্যাটারি সাশ্রয়ে সহায়ক।

ডিসপ্লের রেজোলিউশন ও পিক্সেল ঘনত্ব শার্পনেস নির্ধারণ করে। Full HD+ বা Quad HD+ রেজোলিউশন স্পষ্ট ইমেজ দেয় এবং ৪০০ পিপিআই-এর বেশি হলে পিক্সেল খালি চোখে বোঝা যায় না। রিফ্রেশ রেট স্ক্রিনের মসৃণতা বাড়ায়, যেখানে ৬০ হার্জ স্ট্যান্ডার্ড হলেও ৯০ বা ১২০ হার্জ স্ক্রলিং ও গেমিং অভিজ্ঞতাকে উন্নত করে। কিছু ডিসপ্লেতে অ্যাডাপ্টিভ রিফ্রেশ রেট থাকে, যা কন্টেন্ট অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিবর্তন হয়, ফলে ব্যাটারি কম খরচ হয়।

ডিসপ্লের উজ্জ্বলতা যেখানে ৪০০-৬০০ নিট ইনডোর ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট হলেও আউটডোরে স্পষ্টভাবে দেখতে হলে ৮০০ বা তার বেশি নিট প্রয়োজন। HDR সাপোর্ট থাকলে ভিডিও ও গেমের রঙ ও কনট্রাস্ট উন্নত হয়, তবে এজন্য HDR10 বা Dolby Vision সাপোর্ট থাকা দরকার। ডিসপ্লের আকার ও আসপেক্ট রেশিও ব্যবহারের ধরন নির্ধারণ করে। ৬.৫ থেকে ৬.৭ ইঞ্চির স্ক্রিন গেমিং ও ভিডিও দেখার জন্য ভালো হলেও পকেটে বহন করা কিছুটা কঠিন হতে পারে। দীর্ঘ আসপেক্ট রেশিও (যেমন ২০:৯) ভিডিও দেখার সময় ব্ল্যাক বর্ডার কম দেখায়।

টাচ স্যাম্পলিং রেট বেশি হলে গেমিং ও দ্রুত টাইপিং আরও সহজ হয়। ডিসপ্লে সুরক্ষার জন্য গরিলা গ্লাস ভিক্টাস বা ড্রাগনট্রেইল ব্যবহৃত হয়, যা স্ক্র্যাচ ও ফাটল থেকে রক্ষা করে। কিছু বাড়তি ফিচারের মধ্যে অলওয়েজ-অন ডিসপ্লে (AOD) স্ক্রিন বন্ধ থাকলেও সময় ও নোটিফিকেশন দেখাতে পারে, যা ওএলইডি ডিসপ্লের জন্য উপযুক্ত। কার্ভড এজ ডিসপ্লে দেখতে সুন্দর হলেও এক্সিডেন্টাল টাচের সমস্যা তৈরি করতে পারে। আন্ডার-ডিসপ্লে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেন্সর আধুনিক ফোনে জনপ্রিয়, তবে এর গতি ও নির্ভুলতা ফোনভেদে ভিন্ন হতে পারে।

রঙের যথার্থতার জন্য sRGB বা DCI-P3 কালার প্রোফাইল সাপোর্ট থাকা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে ফটো এডিটিংয়ের ক্ষেত্রে। কিছু ফোনে কালার ক্যালিব্রেশন অপশন থাকে, যা রঙকে আরও বাস্তবসম্মত করে। চোখের আরামের জন্য ব্লু লাইট ফিল্টার বা নাইট মোড ব্যবহার করা যেতে পারে, তবে ওএলইডি ডিসপ্লেতে PWM প্রযুক্তির কারণে কিছু ব্যবহারকারীর চোখে স্ট্রেইন হতে পারে, যা এলসিডি ডিসপ্লের ডিসি ডিমিং প্রযুক্তি কমিয়ে আনতে সাহায্য করে।

ডিসপ্লে বাছাইয়ের সময় প্রয়োজন বুঝে সিদ্ধান্ত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ। গেমিং বা কন্টেন্ট ক্রিয়েশনের জন্য অ্যামোলেড বা ওএলইডি, ১২০ হার্জ রিফ্রেশ রেট ও HDR সাপোর্ট হলে সবচেয়ে ভালো, যেখানে সাধারণ ব্যবহারের জন্য ৯০ হার্জ রিফ্রেশ রেট ও Full HD+ রেজোলিউশন যথেষ্ট। ব্যাটারি লাইফ বাড়াতে LTPO টেকনোলজি ও অ্যাডাপ্টিভ রিফ্রেশ রেট ভালো হতে পারে। দামি ফোনের ডিসপ্লে ফিচার উন্নত হলেও অনেক বাজেট ফোনেও ভালো ডিসপ্লে পাওয়া যায়। তাই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ডিসপ্লে হাতে দেখে রঙ, উজ্জ্বলতা ও টাচ রেসপন্স যাচাই করে তারপর নিবেন।

৫। ক্যামেরা

ভালো ক্যামেরার জন্য শুধু মেগাপিক্সেল নয়, সেন্সরের আকার, অ্যাপারচার (f/1.8 বা কম), OIS স্ট্যাবিলাইজেশন, ও সফটওয়্যার প্রসেসিং গুরুত্বপূর্ণ। বড় সেন্সর বেশি আলো ধরে, ফলে কম আলোতেও ভালো ছবি তোলে। HDR, AI প্রসেসিং ও নাইট মোড থাকলে ছবির গুণমান ভালো হয়।

লেন্সের ধরন

  • আল্ট্রা-ওয়াইড: বড় ফ্রেমে ছবি তোলার জন্য
  • টেলিফটো: অপটিক্যাল জুমে স্পষ্ট ছবি
  • ম্যাক্রো: কাছের বস্তু তোলার জন্য (সকল ফোনে কার্যকর নয়)

ভিডিওগ্রাফি
4K/8K রেকর্ডিং, 60FPS, OIS ও Dolby Vision HDR থাকলে ভিডিওর মান উন্নত হয়। সেলফি ক্যামেরায় অটোফোকাস থাকলে ভালো পারফরম্যান্স দেয়।

৬। ব্যাটারি

মোবাইল ফোন কেনার আগে ব্যাটারির ক্ষমতা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ফোনের ব্যাকআপ নির্ধারণ করে। সাধারণত ৪৫০০ থেকে ৫০০০mAh ব্যাটারি ভালো ব্যাকআপ দেয়, তবে এটি ডিসপ্লের রিফ্রেশ রেট, প্রসেসরের দক্ষতা এবং সফটওয়্যার অপ্টিমাইজেশনের ওপর নির্ভর করে। উচ্চ রিফ্রেশ রেট (৯০Hz/১২০Hz) ও শক্তিশালী চিপসেট থাকলে ব্যাটারি দ্রুত শেষ হতে পারে, তাই LTPO ডিসপ্লে বা অ্যাডাপ্টিভ রিফ্রেশ রেট সুবিধা থাকলে ব্যাটারি দীর্ঘস্থায়ী হয়। চার্জিং স্পিডও গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ২৫W, ৩৩W, ৬৭W বা ১২০W ফাস্ট চার্জিং প্রযুক্তি পাওয়া যায়। বেশি ওয়াটের চার্জিং কম সময়ে ব্যাটারি পূর্ণ করতে পারে, তবে দীর্ঘমেয়াদে ব্যাটারির আয়ুষ্কাল কমতে পারে। ওয়্যারলেস চার্জিং থাকলে সুবিধা বাড়ে, বিশেষ করে যারা প্রতিদিন চার্জিং ক্যাবল ব্যবহারে বিরক্ত হন।

৭। অপারেটিং সিস্টেম

মোবাইলের অপারেটিং সিস্টেম (OS) নির্ধারণ করে ফোনের পারফরম্যান্স, ইউজার এক্সপেরিয়েন্স ও আপডেট এর সুবিধা। iOS দ্রুত, দীর্ঘমেয়াদী আপডেট পায়, তবে কাস্টমাইজেশন সীমিত। অ্যান্ড্রয়েড বেশি ফ্লেক্সিবল, কিন্তু ব্র্যান্ডভেদে সফটওয়্যার অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়। স্টক অ্যান্ড্রয়েড ক্লিন, যেখানে কাস্টম UI (One UI, MIUI) বাড়তি ফিচার দেয় কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ব্লটওয়্যার থাকতে পারে। আপডেট কতদিন পাওয়া যাবে তা দেখাও গুরুত্বপূর্ণ—স্যামসাং ও গুগল ৭ বছর পর্যন্ত আপডেট দেয়, অন্যরা ২-৩ বছর পর্যন্ত। ফোন কেনার আগে সফটওয়্যার অপ্টিমাইজেশন ও আপডেট নীতিমালা যাচাই করে নিন।

৮। নেটওয়ার্ক

মোবাইলের নেটওয়ার্ক সাপোর্ট নির্ধারণ করে কল কোয়ালিটি, ইন্টারনেট স্পিড ও ভবিষ্যৎ ব্যবহারযোগ্যতা। ৫জি সাপোর্ট থাকলে ভবিষ্যতে আপগ্রেডের প্রয়োজন হবে না, তবে বর্তমান ব্যবহারের জন্য ৪জি যথেষ্ট। ব্যান্ড সাপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যদি ভ্রমণ বেশি করেন। বেশি ৪জি/৫জি ব্যান্ড থাকলে নেটওয়ার্ক কাভারেজ ভালো পাওয়া যায়। VoLTE ও VoWiFi সুবিধা থাকলে দুর্বল সিগন্যাল এলাকাতেও ভালো কল কোয়ালিটি নিশ্চিত হয়।

৯। ব্র্যান্ড

মোবাইল ফোনের ব্র্যান্ড নির্ধারণ করে এর হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার অপটিমাইজেশন, আপডেট নীতিমালা ও বিক্র সেবা। অ্যাপল, স্যামসাং, গুগল ফ্ল্যাগশিপ মোবাইল ক্যাটাগরিতে নির্ভরযোগ্য, দীর্ঘমেয়াদী আপডেট ও প্রিমিয়াম অভিজ্ঞতা দেয়। শাওমি, রিয়ালমি, ওয়ানপ্লাস মোবাইল ফোনগুলো ভালো স্পেসিফিকেশন দেয় বাজেট ও মিড-রেঞ্জ সেগমেন্টের মধ্যে। ভিভো ও অপ্পো মোাবইল ফোন ক্যামেরা ও ডিজাইনে ফোকাস করে, আর গেমিং ফোনের জন্য আসুস আরওজি বা রেডম্যাজিক ভালো অপশন। ফোন কেনার আগে ব্র্যান্ডের আপডেট সাপোর্ট, সার্ভিস সেন্টারের সুবিধা ও রিভিউ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

১০। রিভিউ

সবকিছু যাচাই করার পর যদি দেখেন ফোনটির রিভিউ ভালোনা তহলে কিন্তু কখনো সেই ফোনটি কেনা যাবেনা। একটি জিনিস ভালো খারাপ সেটা সবচাইতে ভালো বোঝা যায় ব্যবহার করার মাধ্যমে। তাই অবশ্যই ভালো রিভিউ সম্পন্ন মোবাইল ফোনটি নিবেন। তার জন্য অনলাইনে ইউটিউব রিভিউ, টেক ব্লগ, বা ফেসবুক গ্রুপ থেকে রিভিউ দেখে নিতে পারেন । অনলাইনে এমন অনেক ভিডিও পাওয়া যায়।

সবশেষে আপনার প্রয়োজন ও বাজেটের সাথে মিল রেখে সিদ্ধান্ত নিন, সময় নিয়ে রিসার্চ করুন এবং সঠিক পছন্দ করুন! 😊

অ্যান্ড্রয়েড ফোনের মেমোরি থেকে ডিলিট হওয়া ছবি ফিরে পাওয়ার উপায়

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো