ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় মেমরি স্টোরেজে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন

সম্প্রতি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা মেমরি স্টোরেজে নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করে চমক সৃষ্টি করেছে। ইন্ডিয়াম সেলেনাইড নামক একটি বিশেষ উপাদানের মাধ্যমে ক্রিস্টাল থেকে গ্লাসে রূপান্তর করতে, পূর্বের চেয়ে এক বিলিয়ন গুণ কম শক্তি। এই নতুন আবিষ্কারটি মেমরি স্টোরেজে একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে, বিশেষ করে শক্তি সাশ্রয়ের ক্ষেত্রে।

এই গবেষণাটি প্রথমবারের মতো প্রকাশিত হয়েছে ৬ই নভেম্বর “নেচার” জার্নালে। এতে বলা হয়েছে যে, ইন্ডিয়াম সেলেনাইড নামক উপাদানটি নিজের ক্রিস্টালিন থেকে গ্লাসে রূপান্তর করতে পারে এবং এতে প্রয়োজন হয় খুব সামান্য শক্তি। এই রূপান্তর প্রক্রিয়া, যা মেমরি স্টোরেজ ডিভাইসগুলিতে ব্যবহৃত হয়, বিশেষ করে সিডি ও কম্পিউটার র‌্যাম এর মতো ডিভাইসগুলিতে, প্রচলিত মেল্ট-কোয়েঞ্চ পদ্ধতির তুলনায় এক বিলিয়ন গুণ কম শক্তি প্রয়োজন হয়। মেল্ট-কোয়েঞ্চ পদ্ধতিতে সাধারণত ক্রিস্টালকে গলানো হয় এবং দ্রুত ঠাণ্ডা করা হয়, যা প্রচুর পরিমাণ শক্তি প্রয়োজন করে।

এই গবেষণায় ভারতের ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স (আইআইএসসি), পেনসিলভানিয়া ইউনিভার্সিটির স্কুল অব ইঞ্জিনিয়ারিং এবং অ্যাপ্লাইড সায়েন্স (পেন ইঞ্জিনিয়ারিং), এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (এমআইটি) এর বিজ্ঞানীদের একটি সহযোগিতামূলক দল অংশগ্রহণ করেছে।

আরও পড়ুনঃ ইলেকট্রনিক জিহ্বা : খাবারের সতেজতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করার নতুন প্রযুক্তি

মেমরি ডিভাইসে গ্লাস ট্রানজিশন

গ্লাস দেখতে সলিডের মতো মনে হয়, কিন্তু এটিতে কোনো নির্দিষ্ট পারমাণবিক বিন্যাস থাকে না। সাধারণত গ্লাস তৈরির সময় একটি ক্রিস্টালকে গলিয়ে তরলে রূপান্তরিত করা হয় এবং দ্রুত ঠাণ্ডা করা হয় যাতে এটি পুনরায় ক্রিস্টালে পরিণত না হয়। এই মেল্ট-কোয়েঞ্চ পদ্ধতি সিডি, ডিভিডি এবং ব্লু-রে ডিস্কে ব্যবহৃত হয়, যেখানে লেজার পালস ব্যবহার করে একটি ক্রিস্টালিন উপাদানকে দ্রুত গ্লাসি অবস্থায় নিয়ে আসা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তথ্য লেখা হয় এবং এটি উল্টে দিলে তথ্য মুছে ফেলা যায়।

কম্পিউটারেও এই ধরনের উপাদান ব্যবহৃত হয়, যেগুলোকে ফেজ-চেঞ্জ র‌্যাম বলা হয়। এতে তথ্য সংরক্ষণ করা হয় গ্লাসি এবং ক্রিস্টালিন অবস্থায় প্রদত্ত ভিন্ন ধরনের প্রতিরোধের ভিত্তিতে। কিন্তু এই প্রক্রিয়াটি খুবই শক্তি-নিবিড়, বিশেষ করে লেখার সময়। ক্রিস্টালগুলোকে ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসেরও বেশি তাপমাত্রায় গরম করতে হয় এবং দ্রুত ঠাণ্ডা করতে হয়। যদি ক্রিস্টালকে সরাসরি তরল অবস্থায় না নিয়ে গ্লাসে রূপান্তর করা যায়, তাহলে এই মেমরি স্টোরেজের প্রয়োজনীয় শক্তি অনেকটাই কমে আসবে।

ইন্ডিয়াম সেলেনাইডে লো-এনার্জি অ্যামরফাইজেশন আবিষ্কার

গবেষণায় দেখা গেছে, যখন ইন্ডিয়াম সেলেনাইডের তারগুলোর মধ্য দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়, তখন এর দীর্ঘাংশ গ্লাসে রূপান্তরিত হয়। এটি একটি ২ডি ফেরোইলেকট্রিক উপাদান। প্রথমবারের মতো এটি দেখে গবেষক গৌরব মোদী মনে করেছিলেন, হয়তো তিনি উপাদানটি নষ্ট করে ফেলেছেন। কারণ সাধারণত অ্যামরফাইজেশন ঘটানোর জন্য বৈদ্যুতিক পালসের প্রয়োজন হয়, এবং এখানে কন্টিনিউয়াস কারেন্ট দ্বারা ক্রিস্টালিন গঠন ভেঙে গ্লাসে রূপান্তরিত হচ্ছিল, যা আগে কখনো দেখা যায়নি।

মোদী এবং রিতেশ আগরওয়াল, পেন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এবং ইঞ্জিনিয়ারিং এর শ্রীনিবাসা রামানুজন ডিস্টিংগুইশড স্কলার, এবং আইআইএসসি এর পবন নুকালা এই প্রক্রিয়াটিকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। নুকালার সহযোগিতায় তাঁর পিএইচডি ছাত্র শুভম পারাতে পুরো প্রক্রিয়াটিকে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে পারমাণবিক থেকে মাইক্রোমিটার দৈর্ঘ্যের স্কেলে পর্যবেক্ষণ করেছেন।

স্লাইডিং লেয়ার এবং ডোমেইন ফর্মেশন: ভূমিকম্পের মতো প্রভাব

গবেষণায় দেখা গেছে, যখন ইন্ডিয়াম সেলেনাইডের ২ডি লেয়ারগুলোর মধ্য দিয়ে ক্রমাগত বিদ্যুৎ প্রবাহিত করা হয়, তখন লেয়ারগুলো একে অপরের বিপরীত দিকে সরে যায়। এতে তৈরি হয় ডোমেইন নামে ছোট ছোট অঞ্চল। এই ডোমেইনগুলোতে নির্দিষ্ট ডাইপোল মোমেন্ট থাকে এবং এই ডোমেইনগুলোকে আলাদা করে রাখে ত্রুটিযুক্ত অঞ্চলগুলো। যখন এই ত্রুটিগুলো একটি ছোট ন্যানোস্কোপিক অঞ্চলে মিলিত হয়, তখন ক্রিস্টালের গঠন ভেঙে স্থানীয়ভাবে গ্লাসে রূপান্তরিত হয়।

এই ডোমেইন সীমানাগুলো টেকটনিক প্লেটের মতো কাজ করে। তারা বিদ্যুৎ ক্ষেত্রের সাথে মিলে চলে এবং যখন তারা একে অপরের সাথে সংঘর্ষ করে, তখন ভূমিকম্পের মতো যান্ত্রিক (এবং বৈদ্যুতিক) শক তৈরি হয়। এই ভূমিকম্পটি একটি অ্যাভালাঞ্চ প্রভাব সৃষ্টি করে, যা মূল কেন্দ্র থেকে দূরে থাকা এলাকাগুলোতেও প্রভাব ফেলে। এর ফলে আরো ডোমেইন সীমানা তৈরি হয় এবং আরো গ্লাসি অঞ্চল গঠন হয়, যা পরবর্তীতে আরো ভূমিকম্প সৃষ্টি করে। পুরো উপাদানটি গ্লাসে পরিণত হওয়ার আগ পর্যন্ত এই অ্যাভালাঞ্চ চলতে থাকে।

গবেষক শুভম পারাতে এই ঘটনাকে উল্লেখ করে বলেন, “এই প্রক্রিয়ার বিভিন্ন স্তরে ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপের সাহায্যে সবকিছু প্রাণবন্ত হয়ে উঠতে দেখা আসলেই রোমাঞ্চকর।” নুকালা উল্লেখ করেছেন যে ইন্ডিয়াম সেলেনাইডের বিভিন্ন অনন্য বৈশিষ্ট্য – এর ২ডি গঠন, ফেরোইলেকট্রিসিটি এবং পাইজোইলেকট্রিসিটি – একত্রিত হয়ে এই অত্যন্ত নিম্ন শক্তির রূপান্তর প্রক্রিয়ার সুযোগ করে দেয়। তিনি আরো বলেন, “আমরা এটি সিএমওএস প্ল্যাটফর্মে একীভূত করার জন্য পরবর্তী স্তরে নিয়ে যেতে যাচ্ছি।”

নতুন উদ্ভাবন : ডিএনএ স্টোরেজ এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ

পেন ইঞ্জিনিয়ারিং-এর রিতেশ আগরওয়াল বলেন, “ফেজ-চেঞ্জ মেমরি (পিসিএম) ডিভাইসগুলো এখনো ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত না হওয়ার অন্যতম কারণ হলো এদের জন্য প্রয়োজনীয় শক্তির পরিমাণ।” এই নতুন আবিষ্কারটি পিসিএম ডিভাইসের জন্য শক্তি প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে আরো বিস্তৃতভাবে ব্যবহারের পথ উন্মুক্ত করতে পারে, যা স্মার্টফোন থেকে শুরু করে কম্পিউটার পর্যন্ত বিভিন্ন ডিভাইসে ডেটা স্টোরেজে বিপ্লব ঘটাতে পারে।

এই গবেষণার মাধ্যমে মেমরি স্টোরেজ প্রযুক্তিতে যে পরিবর্তন আসতে পারে তা শুধু শক্তি সাশ্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় বরং এটি পরিবেশ বান্ধবও হতে পারে। ভবিষ্যতে এই ধরনের প্রযুক্তি আরো উন্নত হয়ে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের তথ্য সংরক্ষণে সহায়ক হতে পারে। ইন্ডিয়াম সেলেনাইডের মতো উপাদানগুলোর মাধ্যমে এই প্রযুক্তি ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে এবং এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে মেমরি স্টোরেজের শক্তি ব্যবহার অনেকটাই কমানো যাবে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো