এনভিডিয়া বর্তমানে আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান শক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কোম্পানিটি বিশেষভাবে গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট (GPU) তৈরিতে বিশেষজ্ঞ, যা এআই (AI) মডেলগুলির প্রশিক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য অপরিহার্য। জেনসেন হুয়াং এর নেতৃত্বে এনভিডিয়া এর উদ্ভাবনী প্রযুক্তি এবং বাজারে নেতৃত্ব বজায় রাখার প্রচেষ্টা কোম্পানিটিকে অসাধারণ সাফল্য এনে দিয়েছে। গত এক বছরে এনভিডিয়া তার বাজার মূল্য বৃদ্ধি করে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে এবং এটি অ্যাপল এর স্থান দখল করে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান প্রযুক্তি কোম্পানি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এই প্রবন্ধে এনভিডিয়া এর সাম্প্রতিক সাফল্য, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা করা হবে।
এনভিডিয়া এর সাম্প্রতিক সাফল্য
এনভিডিয়া এর সাম্প্রতিক সাফল্যের অন্যতম কারণ হল তাদের GPU চিপগুলির শক্তিশালী ক্ষমতা। এই চিপগুলো শত শত কাজ একসঙ্গে করতে সক্ষম, যা এআই প্রযুক্তি, যেমন চ্যাটবট, সফটওয়্যার কোড লেখা, এবং নতুন ওষুধ আবিষ্কারের জন্য অপরিহার্য। অক্টোবর মাসে সমাপ্ত হওয়া প্রান্তিকে কোম্পানিটির আয় ৩৫.০৮ বিলিয়ন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৯৪ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। একই সময়ে, কোম্পানিটির মুনাফা ১০৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ১৯.০৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।
এই সাফল্যের বড় একটি অংশ এসেছে এনভিডিয়া এর নতুন এবং উন্নত GPU চিপ ব্ল্যাকওয়েল এর বিক্রয় থেকে। কোম্পানিটি জানিয়েছে যে বর্তমানে গ্রাহকদের জন্য পর্যাপ্ত ব্ল্যাকওয়েল চিপ উৎপাদন করা একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এটি পরবর্তী কয়েকটি প্রান্তিকে বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ করতে পারবে বলে আশাবাদী। এনভিডিয়া এর CFO Colette Kress জানিয়েছেন যে কোম্পানিটি দ্রুত সরবরাহ বাড়ানোর জন্য আরও অনেক সরবরাহকারীর সঙ্গে কাজ শুরু করবে।
আরও পড়ুনঃ রাশিয়ার কাছে নিষিদ্ধ এনভিডিয়া চিপ সরবরাহ করেছে ভারত
এআই এবং এনভিডিয়া এর বাজারে অবস্থান
এনভিডিয়া এর CEO জেনসেন হুয়াং এর মতে, এআই প্রযুক্তির গুরুত্ব এবং প্রভাব আগামী কয়েক দশকে শিল্প বিপ্লবের মতোই হবে। তিনি বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করে এআই এর গুরুত্ব এবং এনভিডিয়া এর প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং এই দেশগুলোকে ডেটা সেন্টার তৈরি করতে উৎসাহিত করেছেন। এনভিডিয়া এর বর্তমান বাজারে প্রভাবের মূল কারণ হল তাদের GPU চিপগুলি এআই মডেলগুলিকে প্রশিক্ষণ দিতে এবং নতুন সিস্টেম তৈরি করতে সহায়ক। এই চিপগুলি এআই এর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ এবং ইন্টারফেসের সময় ব্যবহৃত হয়।
এআই (AI) গবেষণা এবং GPU এর ভবিষ্যৎ
এনভিডিয়া এর এআই গবেষণার ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্ভাবনী পদ্ধতি হচ্ছে “o1” মডেল বা “টেস্ট-টাইম স্কেলিং”। এটি এআই মডেলগুলিকে আরও বেশি সময় এবং কম্পিউটিং শক্তি দেয়, যাতে তারা আরও ভালো উত্তর দিতে পারে। জেনসেন হুয়াং এর মতে, এটি এআই এর একটি অন্যতম উত্তেজনাপূর্ণ উন্নয়ন এবং এনভিডিয়া এর ব্যবসায় আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। যদিও বাজারে অনেক স্টার্টআপ কোম্পানি দ্রুতগতির এআই চিপ তৈরি করছে, এনভিডিয়া এর আস্থা তাদের GPU চিপের মান এবং স্থায়িত্বের উপর।
জেনসেন হুয়াং উল্লেখ করেছেন যে এনভিডিয়া বর্তমানে এআই মডেলগুলির প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্ল্যাটফর্ম, এবং ভবিষ্যতে এআই মডেল চালানোর প্রয়োজন বাড়বে। এনভিডিয়া এর স্কেল এবং নির্ভরযোগ্যতা স্টার্টআপগুলির তুলনায় অনেক বেশি সুবিধাজনক। Huang এর মতে, “আমাদের আশা এবং স্বপ্ন হলো একদিন এআই মডেল চালানোর প্রচুর প্রয়োজন হবে, এবং তখন এআই সত্যিই সফল হবে।”
ব্ল্যাকওয়েল চিপ এবং এর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
এনভিডিয়া সম্প্রতি ব্ল্যাকওয়েল চিপের উন্নয়নের মাধ্যমে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ব্ল্যাকওয়েল চিপটির একটি প্রিমিয়াম সংস্করণ, GB200 NVL72, যা একটি কম্পিউটার সার্ভার হিসেবে কাজ করে এবং এর মধ্যে রয়েছে ৭২টি GPU। এই চিপের মাধ্যমে এআই মডেলগুলিকে আরও দ্রুত প্রশিক্ষণ এবং পরিচালনা করা সম্ভব হবে। এনভিডিয়া জানিয়েছে যে এই চিপের চাহিদা এতটাই বেশি যে এর উৎপাদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করা প্রয়োজন। তবে কোম্পানিটি আশাবাদী যে তারা শীঘ্রই সরবরাহ বাড়াতে পারবে।
Huang এর মতে, “আমরা সবাই বাজি ধরছি যে এআই কম্পিউটিংয়ের একটি প্রধান পরিবর্তন আসছে, এবং এই পণ্যটিই সেই পরিবর্তন।” এনভিডিয়া এর ব্ল্যাকওয়েল চিপগুলির মাধ্যমে এআই মডেলের ইন্টারফেস এবং প্রশিক্ষণের সময় আরও বেশি উন্নতি করা সম্ভব হবে।
এনভিডিয়া এর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
জেনসেন হুয়াং এর মতে, এনভিডিয়া এবং এআই প্রযুক্তির সম্ভাবনা এখনো অনেক বাকি রয়েছে। তিনি উল্লেখ করেছেন যে এআই সেবা বর্তমানে অনেক ক্ষেত্রেই ২৪/৭ চলমান থাকে, যা একটি ফ্যাক্টরির মতো। এনভিডিয়া এর ডেটা সেন্টারগুলোকে Huang এআই ফ্যাক্টরি হিসেবে বর্ণনা করেছেন কারণ এগুলো মূলত এআই মডেল তৈরির কারখানা। এনভিডিয়া এর ব্ল্যাকওয়েল চিপগুলোর পাশাপাশি কোম্পানিটি ভবিষ্যতে আরও উন্নত GPU তৈরি করার পরিকল্পনা করছে। Huang জানিয়েছেন যে এনভিডিয়া প্রতিবছর তাদের GPU লাইন আপডেট করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, এবং ২০২৬ সালে ব্ল্যাকওয়েল এর পরবর্তী সংস্করণ বাজারে আনার পরিকল্পনা রয়েছে।
জেনসেন হুয়াং আরও বলেছেন যে কোম্পানিটি নতুন ধরনের কম্পিউটিং সিস্টেম তৈরিতে অঙ্গীকারবদ্ধ, যা প্রচলিত ডেটা সেন্টারের মতো নয় বরং এআই প্রশিক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত। এনভিডিয়া এর এই উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা এবং তাদের চিপগুলির চাহিদা ভবিষ্যতে কোম্পানিটিকে আরও বড় সাফল্যের দিকে নিয়ে যাবে বলে আশা করা যায়।
চীন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হাইপারগ্র্যাভিটি মেশিন তৈরি করেছে
এনভিডিয়া এর সামনে চ্যালেঞ্জ
তবে এনভিডিয়া এর সামনে কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। কোম্পানিটি নতুন ব্ল্যাকওয়েল চিপের উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা নিয়ে কাজ করছে। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং চীন তাদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম সম্পর্কে তদন্ত করছে। এনভিডিয়া জানিয়েছে যে তারা তদন্তকারীদের প্রয়োজনীয় সমস্ত তথ্য প্রদান করবে। এনভিডিয়া এর আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো নতুন নতুন এআই মডেলের চাহিদা পূরণ করা এবং প্রতিযোগী কোম্পানির সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা।
তবুও, এনভিডিয়া এর CEO এবং CFO উভয়েই আশাবাদী যে কোম্পানির ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। এআই প্রযুক্তির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং নতুন উদ্ভাবনগুলি এনভিডিয়া কে আগামীতে আরও সাফল্য এনে দেবে। Huang এবং Colette Kress এর মতে, এনভিডিয়া এর চিপ এবং ডেটা সেন্টারগুলি এখনও অনেক কোম্পানি এবং দেশের জন্য অপরিহার্য, এবং এটি ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
এনভিডিয়া এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
এনভিডিয়া এর CEO জেনসেন হুয়াং এআই এর উদ্ভাবনী শক্তিতে বিশ্বাসী। তিনি মনে করেন যে এআই প্রযুক্তি এবং এনভিডিয়া এর মতো কোম্পানিগুলি ভবিষ্যতের প্রযুক্তিগত উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কোম্পানিটি এআই মডেলের প্রশিক্ষণ এবং পরিচালনার জন্য উন্নত GPU তৈরি করছে এবং এআই প্রযুক্তির উন্নয়নে নতুন পদ্ধতি গ্রহণ করছে। এনভিডিয়া এর উদ্ভাবনী প্রচেষ্টা এবং তাদের প্রযুক্তির প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস কোম্পানিটিকে বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান কোম্পানি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
শেষ পর্যন্ত বলা যায় যে এনভিডিয়া এর সাফল্যের পেছনে তাদের উদ্ভাবনী শক্তি, GPU চিপের দক্ষতা এবং এআই প্রযুক্তির প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কোম্পানিটি আগামীতে আরও বড় সাফল্য অর্জনের জন্য প্রস্তুত এবং এআই এর নতুন সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার মানুষের ব্রেনের মতো কাজ করবে, মেমরিস্টর ও নিউরোমরফিক কম্পিউটিং