পদার্থবিদরা সময় পরিমাপের একটি নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছেন

আমরা সাধারণত সময় পরিমাপ করতে ঘড়ি, পেন্ডুলাম বা সেকেন্ড গুণার মতো পদ্ধতি ব্যবহার করি। কিন্তু কোয়ান্টাম স্তরের ইলেকট্রনগুলোর মাঝে এই সময় ধারণা অনেক জটিল হয়ে যায়। ‘তখন’ বা ‘এখন’ বলতে কোয়ান্টাম স্তরে আসলে কী বোঝায়, সেটা পরিষ্কার নয়। এখানে একটি সাধারণ স্টপওয়াচ কখনোই কার্যকর হতে পারে না। এই সমস্যার সমাধান হতে পারে কোয়ান্টাম কুয়াশার বিশেষ আকার। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ২০২২ সালে তাদের গবেষণায় এ ধরনের একটি নতুন পদ্ধতি প্রস্তাব করেছেন। এই পদ্ধতি সময় পরিমাপ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন শুরুর পয়েন্টের প্রয়োজন হয় না।

রাইডবার্গ অবস্থা এবং কোয়ান্টাম সময় পরিমাপ

রাইডবার্গ অবস্থা বলতে ইলেকট্রনের এমন একটি অবস্থাকে বোঝায় যেখানে এটি প্রচুর পরিমাণে শক্তি ধারণ করে এবং নিউক্লিয়াস থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। গবেষকরা লেজারের মাধ্যমে ইলেকট্রনকে উচ্চ শক্তির স্তরে উত্তোলিত করে রাইডবার্গ অবস্থা সৃষ্টি করেন। এটা অনেকটা বড় একটি বেলুনের মতো যা বাতাসের পরিবর্তে লেজারের মাধ্যমে পূর্ণ করা হয়। এই অবস্থায় ইলেকট্রনগুলি খুব বেশি শক্তি ধরে রাখে এবং নিউক্লিয়াস থেকে বেশ দূরে অবস্থান করে।

সাধারণত লেজার ব্যবহারের মাধ্যমে ইলেকট্রনকে বিভিন্ন শক্তির স্তরে উত্তোলিত করা হয়, যা বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে একটি প্রক্রিয়া হল ‘পাম্প-প্রোব’ পদ্ধতি যেখানে একটি লেজারের মাধ্যমে ইলেকট্রন উত্তোলিত হয় এবং আরেকটি লেজার দিয়ে ইলেকট্রনের অবস্থান এবং গতিবিধি পরিমাপ করা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ইলেকট্রনের গতি ও সময় পরিমাপ করা সম্ভব হয়।

আরও পড়ুনঃ মানব মস্তিষ্কের এমন কিছু তথ্য যা আপনি আগে কখনো শোনেননি!

রাইডবার্গ অবস্থা তৈরির মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটারের বিভিন্ন অংশ ডিজাইন করা যায়, যা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য অনেক সহায়ক। তবে রাইডবার্গ অবস্থা সৃষ্টি হলে ইলেকট্রনের চলাচল অনেকটা এলোমেলো হয়ে যায়। এরা বিডের মতো সোজাসুজি চলে না, বরং অনেকটা রুলেট খেলার মতো এলোমেলো ভাবে চলতে থাকে। এটি গণিতের ভাষায় রাইডবার্গ ওয়েভ প্যাকেট নামে পরিচিত।

রাইডবার্গ ওয়েভ প্যাকেটের সাহায্যে সময় পরিমাপ

রাইডবার্গ ওয়েভ প্যাকেটগুলির আচরণ অনেকটা তরঙ্গের মতো। যখন একই স্থানে একাধিক রাইডবার্গ ওয়েভ প্যাকেট থাকে, তখন তারা একে অপরের সাথে হস্তক্ষেপ করে এবং ভিন্ন ভিন্ন ধরণের তরঙ্গ তৈরি করে। এই তরঙ্গগুলির অনন্য আকারগুলো সময়ের বিভিন্ন পরিমাণকে প্রতিফলিত করে। এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে এই ‘ফিঙ্গারপ্রিন্ট’ গুলি যথেষ্ট নির্ভুল এবং নির্ভরযোগ্য যা কোয়ান্টাম স্তরে সময় পরিমাপের একটি উপায় হতে পারে।

তাদের গবেষণায় তারা লেজার দ্বারা উত্তেজিত হিলিয়াম পরমাণুর পরিমাপ করেন এবং তাদের ফলাফলগুলো তাত্ত্বিক পূর্বাভাসের সাথে মিলিয়ে দেখেন। এর মাধ্যমে তারা দেখিয়েছেন যে এই বিশেষ আকারগুলো সময় পরিমাপের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি হতে পারে।

উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ মার্টা বারহোল্টস ২০২২ সালে নিউ সায়েন্টিস্টকে বলেছিলেন, “যদি আপনি কাউন্টার ব্যবহার করেন, তবে আপনাকে শূন্য সংজ্ঞায়িত করতে হবে। আপনাকে একটি নির্দিষ্ট বিন্দু থেকে গণনা শুরু করতে হবে। এর সুবিধা হল, আপনাকে ঘড়ি শুরু করতে হবে না – আপনি শুধু হস্তক্ষেপের গঠন দেখেন এবং বলতে পারেন ‘ঠিক আছে, ৪ ন্যানোসেকেন্ড হয়েছে।'”

পাম্প-প্রোব স্পেকট্রোস্কোপি

এই রাইডবার্গ ওয়েভ প্যাকেটের গাইডবুকটি অন্য পাম্প-প্রোব স্পেকট্রোস্কোপির সাথে একত্রে ব্যবহার করা যেতে পারে যা ক্ষুদ্রতম স্তরের ঘটনাগুলি পরিমাপ করে। যখন ‘এখন’ এবং ‘তখন’ ধারণাগুলি পরিষ্কার থাকে না বা মাপা খুব কঠিন হয়, তখন এই গাইডবুকটি সময় পরিমাপের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মানে হল, কোন ঘটনার সময় পরিমাপ করতে হলে ‘তখন’ এবং ‘এখন’ নির্ধারণ করার প্রয়োজন নেই। এটি অনেকটা অজানা স্প্রিন্টারদের দৌড় পরিমাপের মতো যেখানে প্রতিযোগীদের নির্ধারিত গতির সাথে তুলনা করা হয়।

আরও পড়ুনঃ আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব চ্যালেঞ্জের মুখে

এই পদ্ধতির মাধ্যমে রাইডবার্গ অবস্থার হস্তক্ষেপের চিহ্ন পর্যবেক্ষণ করে একটি টাইমস্ট্যাম্প নির্ধারণ করা যায়, যা মাত্র ১.৭ ট্রিলিয়নথ সেকেন্ড পর্যন্তও ক্ষুদ্র হতে পারে। ভবিষ্যতে কোয়ান্টাম ঘড়ি নিয়ে আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হতে পারে, যেখানে হিলিয়ামের পরিবর্তে অন্য পরমাণু ব্যবহার করা হবে অথবা ভিন্ন শক্তির লেজার ব্যবহার করে টাইমস্ট্যাম্পের গাইডবুকটি আরও বিস্তৃত করা হবে।

এই গবেষণা কোয়ান্টাম স্তরে সময় পরিমাপের ক্ষেত্রে নতুন এক দিগন্ত উন্মোচন করেছে। কোয়ান্টাম স্তরে ইলেকট্রনের চলাচল অনেক বেশি এলোমেলো এবং অনিশ্চিত। কিন্তু রাইডবার্গ ওয়েভ প্যাকেটের মাধ্যমে এই অনিশ্চিততাকে নির্দিষ্ট আকারে ফেলা সম্ভব হয়েছে। এর ফলে সময় পরিমাপের নতুন একটি পদ্ধতি সৃষ্টি হয়েছে যেখানে ঘড়ির প্রয়োজন নেই, শুরুর পয়েন্টের প্রয়োজন নেই। শুধু মাত্র তরঙ্গের আকার দেখেই সময় পরিমাপ করা সম্ভব হচ্ছে।

এই গবেষণা কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম স্পেকট্রোস্কোপির ক্ষেত্রে এক নতুন পথ উন্মুক্ত করেছে। ভবিষ্যতে এই পদ্ধতি আরও উন্নত এবং বিস্তৃত হতে পারে, যা কোয়ান্টাম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক বিপ্লব আনবে। তবে এই গবেষণা এখনও প্রাথমিক স্তরে রয়েছে এবং এর পরিপূর্ণ বাস্তবায়নের জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত যে ফলাফল পাওয়া গেছে তা আমাদের সময় পরিমাপের প্রচলিত ধারণাকে নতুন ভাবে ভাবতে বাধ্য করেছে।

মস্তিষ্কে ভালোবাসা আর ক্ষুধার মধ্যে সংঘর্ষ হলে কিভাবে মস্তিষ্ক সিদ্ধান্ত নেয়?

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো