কোয়ান্টাম কম্পিউটার : কি কেন ও কিভাবে?

কোয়ান্টাম কম্পিউটার কি

কোয়ান্টাম কম্পিউটার একটি বিশেষ ধরনের কম্পিউটিং ডিভাইস, যা কোয়ান্টাম মেকানিক্সের নিয়ম অনুসারে কাজ করে। এটি প্রচলিত ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের তুলনায় অনেক বেশি শক্তিশালী এবং জটিল সমস্যার সমাধান দ্রুত করতে সক্ষম। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার যেখানে বিট ব্যবহার করে, সেখানে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিউবিট (কোয়ান্টাম বিট) ব্যবহার করে। কিউবিট একসঙ্গে ০ এবং ১ দুটি অবস্থায় থাকতে পারে, যা কোয়ান্টাম সুপারপজিশন নামে পরিচিত। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো “এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট,” যেখানে একাধিক কিউবিট পরস্পরের সাথে সংযুক্ত থাকে এবং একটির অবস্থান অন্যটির উপর প্রভাব ফেলে। এই বৈশিষ্ট্যগুলো একত্রে কোয়ান্টাম কম্পিউটারকে একই সঙ্গে বহু গণনা করার ক্ষমতা দেয়। এটি বিশেষভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্রিপ্টোগ্রাফি, ড্রাগ ডিজাইন, এবং জলবায়ু পরিবর্তনের মডেলিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। যদিও বর্তমানে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রযুক্তি এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এর উন্নয়নে প্রচুর গবেষণা চলছে, ভবিষ্যতে এটি আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রগুলোতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে।

আরও পড়ুনঃ ফিঙ্গারপ্রিন্ট প্রযুক্তি কি কেন ও কিভাবে?

কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির ইতিহাস?

কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরির ইতিহাস জটিল এবং বিজ্ঞানের যুগান্তকারী গবেষণার ধারাবাহিক একটি ফলাফল। এর ভিত্তি মূলত কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তত্ত্বগুলোর উপর নির্ভর করে, যা ২০শ শতকের প্রথমার্ধে বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন। তবে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের ধারণাটি মূলত উঠে আসে ১৯৮০ সালের দিকে। ১৯৮১ সালে নোবেল বিজয়ী রিচার্ড ফেইনম্যান প্রথমবার উল্লেখ করেন যে, প্রকৃতির জটিল কোয়ান্টাম সিস্টেমকে সঠিকভাবে মডেল করতে হলে আমাদের একটি কোয়ান্টাম কম্পিউটার প্রয়োজন। ক্লাসিক্যাল কম্পিউটার এই কাজটি যথাযথভাবে করতে পারে না। ১৯৯৪ সালে পিটার শোর নামে একজন গণিতবিদ শোরের অ্যালগরিদম উদ্ভাবন করেন। এটি প্রমাণ করে যে কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক দ্রুত সময়ের মধ্যে ফ্যাক্টরাইজেশন করতে পারে। এই অ্যালগরিদমের মাধ্যমে কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ের বাস্তবায়ন সম্ভব এবং এটি ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবস্থার জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। ১৯৯৮ সালে প্রথম কার্যকরী কোয়ান্টাম কম্পিউটারের প্রোটোটাইপ তৈরি করা হয়। এটি ছিল একটি ২-কিউবিট কম্পিউটার, যা নিউক্লিয়ার ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স (NMR) প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ২০০৭ সালে, কানাডিয়ান কোম্পানি ডি-ওয়েব প্রথম কোয়ান্টাম অ্যানিলার নামে একটি ডিভাইস তৈরি করে। যদিও এটি পূর্ণাঙ্গ কোয়ান্টাম কম্পিউটার নয়, এটি নির্দিষ্ট কিছু সমস্যার সমাধান করতে সক্ষম। ২০১৯ সালে, গুগল ঘোষণা করে যে তাদের কোয়ান্টাম কম্পিউটার “সাইকামোর” কোয়ান্টাম সুপ্রিমেসি অর্জন করেছে। এটি মাত্র ২০০ সেকেন্ডে একটি গণনা শেষ করে, যা ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারে প্রায় ১০,০০০ বছর সময় লাগত।

কোয়ান্টাম কম্পিউটার কিভাবে কাজ করে?

কোয়ান্টাম কম্পিউটার মূলত ৪টি ধাপে কাজ করে-

১। কোয়ান্টাম বিট : সাধারণ কম্পিউটারে, একটি বিট ০ বা ১ এ অবস্থান করতে পারে, কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কিউবিট একসাথে ০ এবং ১ দুইটি অবস্থানেই থাকতে পারে। এই অবস্থাকে বলা হয় সুপারপজিশন। এটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের শক্তি বাড়ায় কারণ একসাথে অনেক বেশি তথ্য প্রসেস করা সম্ভব হয়।

২। এন্টারটেইনমেন্ট: কোয়ান্টাম বিটগুলোর মধ্যে একটি অদ্ভুত সম্পর্ক রয়েছে, যাকে বলা হয় এন্টারটেইনমেন্ট। এক কোয়ান্টাম বিটের পরিবর্তন অন্য কোয়ান্টাম বিটে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাব ফেলতে পারে, এমনকি তারা যদি একে অপর থেকে অনেক দূরে অবস্থান করে। এই সম্পর্কটি কোয়ান্টাম কম্পিউটারের গতিশীলতা এবং শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে।

৩। কোয়ান্টাম গেটস: কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো কম্পিউটেশন করতে কোয়ান্টাম গেট ব্যবহার করে, যা সাধারণ কম্পিউটারের লজিক গেটের মতো কাজ করে। তবে কোয়ান্টাম গেটের মাধ্যমে তথ্যের উপর কোয়ান্টাম বৈশিষ্ট্য যেমন সুপারপজিশন এবং এন্টারটেইনমেন্ট প্রভাব ফেলতে পারে, যার ফলে কোয়ান্টাম কম্পিউটার অনেক বেশি সক্ষম।

৪। মেজারমেন্ট: কোয়ান্টাম কম্পিউটারে, একবার কাজ সম্পন্ন হলে, কোয়ান্টাম বিটগুলোকে মাপা হয় এবং তখন তাদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করা হয় (০ অথবা ১)। তবে কোয়ান্টাম বিটের মান নির্ধারণ করার আগে তার সম্ভাব্য অবস্থানগুলো একসাথে থাকে, যা কম্পিউটেশনকে আরও দ্রুত এবং শক্তিশালী করে।

র‌্যাম কি? র‌্যাম কিভাবে কাজ করে? বিস্তারিত তথ্য

কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যা যা করা সম্ভব হবে
  • ক্রিপ্টোগ্রাফি এবং সাইবার সিকিউরিটি: কোয়ান্টাম কম্পিউটিং ক্রিপ্টোগ্রাফির ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে। বর্তমানের অনেক এনক্রিপশন পদ্ধতি, যেমন RSA, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের কাছে নিরাপদ নয়। ফলে নতুন ধরনের ক্রিপ্টোগ্রাফিক পদ্ধতি বিকাশের প্রয়োজন পড়বে।
  • ওষুধ আবিষ্কার: কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলির ক্ষমতা ব্যবহারের মাধ্যমে নতুন নতুন ওষুধ ও চিকিৎসা পদ্ধতি দ্রুত আবিষ্কার করা সম্ভব হবে। এটি জটিল প্রোটিন গঠন বোঝার জন্য এবং জটিল রাসায়নিক বিক্রিয়ার মডেল তৈরি করতে সাহায্য করবে, যা নতুন ওষুধ তৈরিতে বিপ্লব ঘটাবে।
  • জটিল সিস্টেমের সিমুলেশন: কোয়ান্টাম কম্পিউটিং জলবায়ু পরিবর্তন, মহাকাশ গবেষণা, এবং অর্থনৈতিক মডেলিং এর মতো জটিল সিস্টেমের সিমুলেশন করতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা সঠিকভাবে ভবিষ্যৎ অনুমান করতে এবং বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজে পেতে পারি।
  • কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): কোয়ান্টাম কম্পিউটিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। কোয়ান্টাম মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদমগুলি সাধারণ এআই অ্যালগরিদমের চেয়ে অনেক দ্রুত এবং কার্যকর হতে পারে, যা এআই প্রযুক্তির উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করবে।

তবে, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং নিয়ে এখনো অনেক চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। কিউবিটগুলিকে স্থিতিশীল রাখা এবং ত্রুটি সংশোধনের জন্য বিশেষ প্রযুক্তি দরকার। এছাড়াও, কোয়ান্টাম কম্পিউটারের জন্য নতুন ধরনের সফটওয়্যার এবং অ্যালগরিদম তৈরি করতে হবে, যা বর্তমান ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এখনো কোয়ান্টাম কম্পিউটিং সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত নয়। তবে আগামী কয়েক দশকে এর বিকাশ দ্রুত হবে এবং এটি আমাদের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে। কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এমন একটি ক্ষেত্র, যা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি জগতে বিপ্লব ঘটাবে এবং আমাদের চিন্তার ধরণ পাল্টে দেবে।

মাউস কিভাবে কাজ করে? কি কেন ও কিভাবে?

Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো