কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করতে গবেষকরা বছরের পর বছর চেষ্টা করছেন। কোয়ান্টাম কম্পিউটার সাধারণ কম্পিউটারের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হতে পারে, যার মাধ্যমে এমন কিছু সমস্যার সমাধান করা সম্ভব যা সাধারণ কম্পিউটার দ্বারা সম্ভব নয়। কিন্তু, কোয়ান্টাম কিউবিটের স্থায়িত্ব একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য, সুইজারল্যান্ডের ইটিএইচ জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা তৈরি করেছেন প্রথম মেকানিক্যাল কিউবিট, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে।
কিউবিট কী?
কোয়ান্টাম কম্পিউটারের মূল উপাদান হচ্ছে কিউবিট। সাধারণ কম্পিউটার তথ্য সংরক্ষণ করে বিট আকারে, যা শুধুমাত্র “০” বা “১” হতে পারে। কিন্তু কিউবিটের বিশেষত্ব হলো এটি “০” এবং “১” উভয় অবস্থায় একসাথে থাকতে পারে। এই বৈশিষ্ট্যটিকে বলা হয় সুপারপজিশন, যা কোয়ান্টাম কম্পিউটারের গাণিতিক সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয়।
আরও পড়ুনঃ বিশ্বের সবচেয়ে ছোট কোয়ান্টাম কম্পিউটার তৈরি করেছে চীন
মেকানিক্যাল কিউবিটের উদ্ভাবন
এতদিন পর্যন্ত বেশিরভাগ কোয়ান্টাম কিউবিট তৈরি করা হয়েছে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক উপায়ে, যেখানে সুপারকন্ডাক্টিং উপাদান ব্যবহার করা হয়। তবে, এই ধরনের কিউবিটের স্থায়িত্ব একটি বড় সমস্যা। ইলেকট্রোম্যাগনেটিক কিউবিটগুলো খুব দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়, ফলে এগুলোর নির্ভুলতা কমে যায়। এই সমস্যার সমাধানের জন্য গবেষকরা মেকানিক্যাল কিউবিট তৈরি করেছেন, যা স্থায়িত্বের দিক থেকে অনেক ভালো।
মেকানিক্যাল কিউবিট তৈরি করতে গবেষকরা ব্যবহার করেছেন পাইজোইলেকট্রিক ডিস্ক, যা একটি স্যাফায়ার বেসের উপর স্থাপন করা হয়েছে। এই ডিস্কটি মেকানিক্যাল রেজোনেটর হিসেবে কাজ করে এবং এটি বিভিন্ন কম্পন ধরে রাখতে সক্ষম। এর সাথে একটি সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিট যুক্ত করা হয়েছে, যা একই ধরনের স্যাফায়ার বেসের উপর স্থাপন করা হয়েছিল। এই দুটি অংশ একত্রে কাজ করে একটি কিউবিট তৈরি করে, যা একদিকে সুপারকন্ডাক্টিং উপাদানের নির্ভুলতা ধরে রাখে এবং অন্যদিকে মেকানিক্যাল উপাদানের স্থায়িত্ব প্রদান করে।
মেকানিক্যাল কিউবিটের কার্যপ্রণালী
এই মেকানিক্যাল কিউবিটের প্রধান অংশ হলো একটি অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রাইডের ছোট ডোম, যা স্যাফায়ার ক্রিস্টালের উপর স্থাপন করা হয়েছে। অ্যালুমিনিয়াম নাইট্রাইডের এই ডোমটি বিদ্যুতের প্রবাহে সম্প্রসারিত এবং সংকুচিত হতে পারে, ফলে এতে কম্পন সৃষ্টি হয়। এই কম্পন স্যাফায়ার ক্রিস্টালের মধ্যে প্রতিফলিত হয় এবং কয়েক কোটি সাইকেল পর্যন্ত টিকে থাকে।
এই পুরো প্রক্রিয়ায় সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিটটি একটি নিয়ন্ত্রক হিসেবে কাজ করে। এটি মেকানিক্যাল রেজোনেটরের কম্পনগুলোকে নির্দিষ্টভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। গবেষকরা দেখিয়েছেন যে, এই প্রক্রিয়ায় কিউবিটটি “০” এবং “১” উভয় অবস্থায় একসাথে থাকতে পারে, অর্থাৎ এটি সুপারপজিশন অবস্থা অর্জন করতে সক্ষম।
মেকানিক্যাল কিউবিটের ভবিষ্যৎ
মেকানিক্যাল কিউবিটের উদ্ভাবন কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এটি এখনও সাধারণ কোয়ান্টাম কিউবিটের মতো নির্ভুল নয়, কারণ এর ফিডেলিটি মাত্র ৬০%, যেখানে সুপারকন্ডাক্টিং কিউবিটের ফিডেলিটি ৯৯% এর উপরে। কিন্তু এই মেকানিক্যাল কিউবিটের বিশেষত্ব হলো এটি অনেক বেশি স্থায়ী এবং এটি এমন কিছু ক্ষেত্রেও ব্যবহৃত হতে পারে যেখানে সাধারণ কিউবিট প্রয়োগ করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, মেকানিক্যাল কিউবিট ব্যবহার করে মহাকর্ষের মতো ক্ষুদ্র শক্তির প্রভাবও নির্ণয় করা সম্ভব হতে পারে।
গবেষকরা এখন দুটি মেকানিক্যাল কিউবিট ব্যবহার করে সরল গাণিতিক অপারেশন সম্পন্ন করার পরিকল্পনা করছেন। যদি তারা সফল হন, তাহলে প্রথম দিকের কম্পিউটারের মতো মেকানিক্যাল সুইচগুলো আবারও কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে ফিরে আসতে পারে।
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মেকানিক্যাল কিউবিটের উদ্ভাবন কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে। যদিও এই প্রযুক্তি এখনও উন্নতির প্রয়োজন রয়েছে, তবে এটি ভবিষ্যতের কোয়ান্টাম কম্পিউটারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠতে পারে।
আরও পড়ুনঃ মেমোরি প্রযুক্তিতে নতুন উদ্ভাবন : এবার উচ্চগতির সঙ্গে বজায় থাকবে মেমোরির কার্যকারিতাও