পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপীয় প্রক্রিয়ায় আয়রন মনোক্সাইডের ভূমিকা

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ পরিবহন এবং এর সাথে জড়িত প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলির মধ্যে আয়রন মনোক্সাইডের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি খুঁজে পেয়েছেন যে আয়রন মনোক্সাইড একটি বিশেষ খনিজ যা পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে তাপ পরিবহন করতে সহায়তা করে। এর ফলে টেকটোনিক গতিবিধি এবং আগ্নেয়গিরির ক্রিয়াকলাপের ওপর প্রভাব পড়ে। এই প্রবন্ধে আমরা আয়রন মনোক্সাইডের বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপীয় প্রক্রিয়াগুলির সাথে এর সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করব।

বিজ্ঞানীরা ন্যাশনাল হাই ম্যাগনেটিক ফিল্ড ল্যাবরেটরিতে আয়রন মনোক্সাইডের অনন্য বৈশিষ্ট্য পর্যবেক্ষণ করেছেন। ফ্লোরিডা স্টেট ইউনিভার্সিটির পদার্থবিদ্যা অধ্যাপক ভ্লাদ ডোব্রোসাভলজেভিক এবং তার দলের সদস্য ডেভিড হো এই গবেষণায় নেতৃত্ব দেন। তারা দেখিয়েছেন যে আয়রন মনোক্সাইড একটি বিশেষ অবস্থায় পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে তাপ পরিবহনে সাহায্য করতে পারে।

পৃথিবীর ম্যান্টল এবং আউটার কোরের মধ্যে, যেখানে তাপমাত্রা সূর্যের পৃষ্ঠের তাপমাত্রার প্রায় অর্ধেক এবং চাপ পৃথিবীর গভীরতম সমুদ্রের গভীরতার চেয়ে ১২০০ গুণ বেশি, সেখানে আয়রন মনোক্সাইডের ভিন্নধর্মী বৈশিষ্ট্য প্রকাশিত হয়। আয়রন মনোক্সাইড এই অবস্থায় একটি ‘কোয়ান্টাম ক্রিটিক্যাল স্টেট’-এ প্রবেশ করে, যেখানে এটি একসাথে একটি ইনসুলেটর এবং একটি কন্ডাক্টরের বৈশিষ্ট্য প্রদর্শন করে।

আরও পড়ুনঃ মহাবিশ্বের রহস্যময় কণা অ্যাক্সিয়নের সন্ধান পেয়েছে বিজ্ঞানীরা

এই অবস্থানটি ম্যান্টল এবং কোরের সীমানায় অবস্থিত এবং সেখানে তাপ পরিবহনের জন্য আয়রন মনোক্সাইড একটি গেটকিপারের মতো কাজ করে। যখন এই গেটটি খোলে, তখন তাপ পৃথিবীর কেন্দ্র থেকে উপরের দিকে যেতে পারে এবং এর ফলে টেকটোনিক প্লেটের গতিবিধি, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ এবং ভূমিকম্প দেখা দিতে পারে।

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপীয় প্রক্রিয়ায়
ছবিঃ National MagLab

আয়রন মনোক্সাইডের মাধ্যমে তাপ পরিবহন পৃথিবীর ম্যান্টল এবং কোরের সীমানায় বিশেষ গঠন তৈরি করতে পারে, যা ভূতাত্ত্বিক তাপ প্রবাহের জন্য পথ খুলে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, হাওয়াইয়ের নিচে এই ধরনের তাপ প্রবাহের প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে আয়রন মনোক্সাইডের এই গঠনগুলোই সেই তাপের উৎস যা হাওয়াইয়ের আগ্নেয়গিরি বিস্ফোরণের জন্য দায়ী।

এই গবেষণার ফলাফল ভূ-পৃষ্ঠের তাপীয় প্রক্রিয়া বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আয়রন মনোক্সাইডের অনন্য বৈশিষ্ট্যগুলো আমাদের বোঝার সুযোগ দিচ্ছে কীভাবে পৃথিবীর অভ্যন্তরে গঠিত তাপ ভূপৃষ্ঠে এসে বিভিন্ন ভূতাত্ত্বিক কার্যক্রমের কারণ হয়। তাপ যখন কোর থেকে বেরিয়ে আসে এবং ম্যান্টল দিয়ে ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায়, তখন এটি প্লেট টেকটোনিক গতি, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ এবং ভূমিকম্পের ওপর প্রভাব ফেলে।

গবেষণার নেতৃত্বে থাকা অধ্যাপক ডোব্রোসাভলজেভিক তার ছেলে ভাসিলিজের সাথে এই গবেষণার কাজ শুরু করেন। ভাসিলিজ একজন খনিজ পদার্থবিজ্ঞানী এবং তিনি পৃথিবীর গভীরে থাকা উপাদানের বৈশিষ্ট্য এবং ভূতাত্ত্বিক প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে কাজ করেন। এই গবেষণার মাধ্যমে তারা বুঝতে পেরেছেন যে কঠিন পদার্থ পদার্থবিদ্যায় যে সমস্যাগুলো নিয়ে কাজ করা হয়, তা পৃথিবীর গভীরে থাকা উপাদানের বৈশিষ্ট্য বোঝার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।

আয়রন মনোক্সাইডের এই নতুন আবিষ্কার শুধু পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া বোঝার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি আমাদের এই গ্রহের গঠন এবং ভূতাত্ত্বিক গতিবিধির আরও গভীর ধারণা দেয়। পৃথিবী আসলে একটি বিশাল পদার্থবৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা এবং এই ধরনের গবেষণা আমাদের সেই ব্যবস্থা সম্পর্কে নতুন জানার সুযোগ দেয়।

এই গবেষণাটি সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশনস-এ প্রকাশিত হয়েছে এবং নেচার ফিজিক্সের ‘নিউজ অ্যান্ড ভিউস’ বিভাগে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। বিজ্ঞানীরা আয়রন মনোক্সাইডের এই অসাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং এর প্রভাব নিয়ে আরও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীর গভীরে কী কী ঘটে চলেছে তা নিয়ে এখনও অনেক কিছু জানার বাকি রয়েছে। গবেষকরা আয়রন মনোক্সাইডের এই বৈশিষ্ট্যগুলো নিয়ে আরও বিশদে জানতে এবং কীভাবে এটি ভূপৃষ্ঠের জীবনের ওপর প্রভাব ফেলে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

এই গবেষণার মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা আশা করছেন যে পৃথিবীর গভীরতম অঞ্চলের চাপ এবং তাপমাত্রা সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাওয়া যাবে এবং এর ফলে আরও অনেক চমকপ্রদ তথ্য পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। বিশেষ করে কীভাবে উচ্চ তাপমাত্রায় কোয়ান্টাম প্রভাব প্রকাশিত হয় এবং কীভাবে আয়রন মনোক্সাইড গেটকিপারের মতো তাপ পরিবহনের পথে বাধা দেয়, তা বোঝা যাবে।

আরও পড়ুনঃ সমুদ্রের তাপমাত্রা ব্যবধানকে ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন

পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপীয় প্রক্রিয়া আমাদের জীবনের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপ ভূপৃষ্ঠে এসে ভূতাত্ত্বিক কার্যক্রম পরিচালনা করে, যেমন টেকটোনিক প্লেটের গতি, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণ এবং ভূমিকম্প। এই কার্যক্রমগুলো ভূ-পৃষ্ঠের পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণ হয়, যেমন নতুন পর্বতের গঠন, আগ্নেয়গিরির লাভার মাধ্যমে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, এবং ভূমিকম্পের মাধ্যমে জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি।

এই তাপীয় প্রক্রিয়া পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্রেরও সৃষ্টি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়তা করে, যা আমাদের সৌর বিকিরণ থেকে সুরক্ষা দেয়। যদি পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ তাপীয় প্রক্রিয়া না থাকত, তাহলে টেকটোনিক প্লেটের গতি থেমে যেত, যার ফলে ভূ-পৃষ্ঠের পরিবর্তন এবং নতুন ভূমি গঠন হতো না। আগ্নেয়গিরি এবং ভূমিকম্পও না থাকায় মাটি উর্বরতা হারাত এবং পৃথিবীর জীববৈচিত্র্য হ্রাস পেত। এছাড়া, পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র দুর্বল হয়ে পড়ত, যা সৌর বিকিরণ থেকে সুরক্ষা কমিয়ে দিয়ে আমাদের জীবনের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলত।

 

Comment

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো