গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ ব্যবহার করে মহাকাশ যোগাযোগ সম্ভব কি না, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০১৫ সালে প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেন, যা মহাবিশ্বের জন্য নতুন একটি সম্ভাবনা তৈরি করে দেয়। এর আগে পর্যন্ত, আমরা মূলত আলোর বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পর্যবেক্ষণের ওপর নির্ভর করতাম। বর্তমানে রেডিও তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ করা হয়, কিন্তু বিজ্ঞানীরা এখন ভাবছেন, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ ব্যবহার করে যোগাযোগ সম্ভব কি না। যদিও এটি এখনো আমাদের সক্ষমতার বাইরে, তবু ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথা মাথায় রেখে এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
হাউতিয়ানফু ওয়াং ও ওজগুর বি. আকান নামে দুই গবেষক সম্প্রতি এই বিষয়ে একটি গবেষণা প্রকাশ করেছেন, যেখানে তারা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যোগাযোগ (GWC) ব্যবস্থার সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করেছেন। তারা ব্যাখ্যা করেছেন যে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের সংকেত দীর্ঘ দূরত্বেও দুর্বল হয় না এবং অন্যান্য জটিল মহাকাশিক প্রতিবন্ধকতা সহজেই অতিক্রম করতে পারে। এটি সৌরজগতের বাইরেও যোগাযোগের জন্য অত্যন্ত কার্যকর হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাক হোল পর্যবেক্ষণে উদ্ভুত কিছু তথ্য পেয়েছে নাসা
বর্তমান ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক যোগাযোগ (EMC) ব্যবস্থার কিছু বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। যেমন, সংকেত দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্বল হয়ে যায়, বায়ুমণ্ডলের প্রভাব এবং মহাকাশের বিভিন্ন বিকিরণ সংকেতকে বিকৃত করতে পারে। এছাড়াও, চৌম্বকীয় ঝড় এবং সৌর তড়িৎ ক্রিয়াকলাপের কারণে সংকেত বিভ্রান্ত হতে পারে। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যোগাযোগ (GWC) এই সমস্যাগুলো সহজেই কাটিয়ে উঠতে পারে, কারণ এটি বিকৃতি ও প্রতিফলনের সমস্যায় পড়ে না এবং শক্তি ক্ষয়ও ন্যূনতম হয়।
তবে, মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো শক্তিশালী তরঙ্গ তৈরি করা। মহাকর্ষীয় তরঙ্গ খুব দুর্বল হয় এবং শুধুমাত্র বিশাল ভর বিশিষ্ট মহাজাগতিক ঘটনা, যেমন ব্ল্যাক হোলের সংমিশ্রণ, এই তরঙ্গ তৈরি করতে পারে। এমনকি এই বিশাল ঘটনাগুলোর তরঙ্গও এত দুর্বল যে, তা শনাক্ত করতে লিগো (LIGO) এর মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল ডিটেক্টর প্রয়োজন হয়। তাই প্রথম ধাপে, গবেষকদের এমন একটি কৌশল উদ্ভাবন করতে হবে যা কৃত্রিমভাবে শক্তিশালী মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি করতে সক্ষম।
এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা চলছে। গবেষকরা মেকানিক্যাল রেজোনেন্স, রোটেশনাল ডিভাইস, সুপারকন্ডাক্টিং উপকরণ, উচ্চশক্তির লেজার এবং পার্টিকল বিম সংঘর্ষ ব্যবহার করে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ উৎপাদনের চেষ্টা করছেন। যদিও কিছু প্রচেষ্টায় সম্ভাব্য তরঙ্গ উৎপন্ন হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে, তবে তা এখনো শনাক্ত করার মতো শক্তিশালী নয়।
উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির মহাকর্ষীয় তরঙ্গ তৈরি করা সম্ভব হলেও, তা এতই দুর্বল যে বর্তমান ডিটেক্টরগুলোর পক্ষে তা শনাক্ত করা কঠিন। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য, গবেষকদের এমন ডিটেক্টর তৈরি করতে হবে যা বিস্তৃত ফ্রিকোয়েন্সি ও অ্যামপ্লিটিউড শনাক্ত করতে সক্ষম।
যদিও মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারে, তবে এটি নিজেও কিছু সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন হয়। দীর্ঘ দূরত্ব অতিক্রম করার সময় সংকেতের দুর্বলতা, পর্যায় পরিবর্তন এবং মেরুকরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এছাড়া, ঘন পদার্থ, মহাকাশের বিভিন্ন মহাজাগতিক গঠন এবং চৌম্বক ক্ষেত্রের কারণে সংকেত বিকৃত হতে পারে।
একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো, কীভাবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গকে সংকেত হিসেবে মড্যুলেট করা যায়। প্রচলিত যোগাযোগে আমরা অ্যামপ্লিটিউড মড্যুলেশন (AM) এবং ফ্রিকোয়েন্সি মড্যুলেশন (FM) ব্যবহার করি। কিন্তু মহাকর্ষীয় তরঙ্গের ক্ষেত্রে কীভাবে এই মড্যুলেশন করা যায়, তা এখনো গবেষণার বিষয়। বিজ্ঞানীরা এর জন্য অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল ঘটনা-নির্ভর অ্যামপ্লিটিউড মড্যুলেশন, ডার্ক ম্যাটার-ভিত্তিক ফ্রিকোয়েন্সি মড্যুলেশন, সুপারকন্ডাক্টিং উপাদানের ব্যবহারের মতো বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করছেন। কিন্তু এই পদ্ধতিগুলোর অনেকগুলোই এখনো পরীক্ষার পর্যায়ে রয়েছে।
একটি আকর্ষণীয় ধারণা হলো, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ মড্যুলেশনের জন্য ডার্ক ম্যাটার ব্যবহার করা। তবে এটি চ্যালেঞ্জিং, কারণ এখনো বিজ্ঞানীরা জানেন না ডার্ক ম্যাটার কী এবং এটি কীভাবে কাজ করে। এই ধরনের গবেষণা ভবিষ্যতে আরও গভীর অনুসন্ধানের দাবি রাখে।
যদিও বর্তমানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের মাধ্যমে যোগাযোগ সম্ভব নয়, তবে এটি ভবিষ্যতে মহাকাশ অনুসন্ধানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক যোগাযোগ ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার কারণে দূরবর্তী মিশনে তা কার্যকর নয়, যেখানে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যোগাযোগ অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য হতে পারে।
গবেষকরা বিশ্বাস করেন, প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যোগাযোগ বাস্তব রূপ নিতে পারে। যেমন, একসময় কোয়ান্টাম কম্পিউটিং শুধুমাত্র তাত্ত্বিক ছিল, কিন্তু এখন এটি বাস্তবে কাজ করছে। একইভাবে, বর্তমানে তাত্ত্বিক পর্যায়ে থাকা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ যোগাযোগও ভবিষ্যতে বাস্তবায়িত হতে পারে।
এই গবেষণার প্রধান লক্ষ্য হলো বিজ্ঞানীদের আরও গবেষণার জন্য অনুপ্রাণিত করা এবং মহাকাশ যোগাযোগের ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করা। এটি এখনো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত না হলেও, গবেষকরা মনে করেন যে এটি ভবিষ্যতে মহাকাশ অনুসন্ধান ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব আনতে পারে।
মৃত গ্যালাক্সিতে ফাস্ট রেডিও বিস্ফোরণ শনাক্ত করেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা