মহাকাশ বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি রহস্যময় ডার্ক কমেট এর গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আবিষ্কার করেছেন। এই আবিষ্কার মহাবিশ্বে জীবনের উৎপত্তি এবং পৃথিবীতে জীবনের উপাদান সরবরাহের বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার পথ খুলে দিতে পারে। সম্প্রতি গবেষণায় এই ধরনের ধূমকেতুর সংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে এবং তারা দুটি ভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হয়েছে: বৃহৎ আকারের ডার্ক কমেট, যা সৌরজগতের বাইরের দিকে অবস্থিত, এবং ক্ষুদ্রতর ডার্ক কমেট, যা অভ্যন্তরীণ সৌরজগতে ঘোরে।
ডার্ক কমেট কি এবং এর বৈশিষ্ট্য
ডার্ক কমেট হলো এক ধরনের মহাজাগতিক বস্তু যা দেখতে অনেকটা গ্রহাণুর মতো হলেও আচরণ করে ধূমকেতুর মতো। এদের মূল বৈশিষ্ট্য হলো পৃষ্ঠে থাকা উদ্বায়ী পদার্থের অদৃশ্য গ্যাস নির্গমন, যা তাদের গতিপথে সূক্ষ্ম পরিবর্তন ঘটায়। তবে এদের কোনো দৃশ্যমান লেজ থাকে না, যা সাধারণ ধূমকেতুর ক্ষেত্রে দেখা যায়। ডার্ক কমেটগুলো দুই ধরনের হতে পারে—বৃহৎ আকারের, যা সৌরজগতের বাইরের দিকে অবস্থিত এবং অত্যন্ত উপবৃত্তাকার কক্ষপথে ঘোরে; আর ক্ষুদ্রতর আকারের, যা অভ্যন্তরীণ সৌরজগতের কাছাকাছি প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে আবর্তিত হয়। এদের এই অনন্য বৈশিষ্ট্য ডার্ক কমেটকে মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে একটি রহস্যময় এবং গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার বিষয় হিসেবে তুলে ধরেছে।
আরও পড়ুনঃ আদি কৃষ্ণগহ্বরগুলো মহাকাশে শূন্য গহ্বরবিশিষ্ট গ্রহাণু তৈরি করতে পারে
ডার্ক কমেটের আবিষ্কার প্রথম ডার্ক কমেটটি দুই বছর আগে শনাক্ত করা হয়েছিল। এটি দেখতে অনেকটা গ্রহাণুর মতো ছিল, কিন্তু এর আচরণ ধূমকেতুর মতো। শীঘ্রই এর পরে আরও ছয়টি ডার্ক কমেট আবিষ্কৃত হয়। সর্বশেষ গবেষণায় বিজ্ঞানীরা আরও সাতটি ডার্ক কমেট চিহ্নিত করেছেন, যা মোট সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে। এগুলি দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত: বৃহৎ ডার্ক কমেট এবং ক্ষুদ্র ডার্ক কমেট।
এই গবেষণার ফলাফল “প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস” জার্নালে ৯ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রথম ডার্ক কমেটের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা তৈরি হয়েছিল ২০১৬ সালে, যখন বিজ্ঞানীরা “২০০৩ আরএম” নামক একটি গ্রহাণুর গতিপথে অস্বাভাবিক পরিবর্তন লক্ষ্য করেন। এই পরিবর্তনটি গ্রহাণুতে সাধারণত দেখা যায় এমন গতি পরিবর্তনের কারণ (যেমন ইয়ারকোভস্কি প্রভাব) দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হয়নি। এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন এটি একটি ধূমকেতু হতে পারে, যার পৃষ্ঠ থেকে উড়ে আসা গ্যাস এর গতিপথে পরিবর্তন আনছে। তবে এটির কোনো ধূমকেতুর লেজ দেখা যায়নি, যা এটিকে আরও রহস্যময় করে তোলে।
২০১৭ সালে, আরেকটি রহস্যময় মহাজাগতিক বস্তু আবিষ্কৃত হয়েছিল, যার নাম দেওয়া হয়েছিল ১আই/২০১৭ ইউ১ বা ‘ওউমুয়ামুয়া। এটি সৌরজগতের বাইরে থেকে আসা প্রথম চিহ্নিত বস্তু। এটি দেখতে অনেকটা গ্রহাণুর মতো হলেও এর গতিপথ ধূমকেতুর মতো আচরণ করছিল। এর ফলে বিজ্ঞানীরা আরও বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং ডার্ক কমেট নিয়ে গবেষণায় মনোযোগ দেন।
ডার্ক কমেটের ভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য নতুন আবিষ্কৃত ডার্ক কমেটগুলো বিশ্লেষণ করে গবেষকরা দেখতে পান যে, এগুলি দুটি ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত। প্রথম গোষ্ঠীর নাম দেওয়া হয়েছে “বাইরের ডার্ক কমেট”। এরা বৃহৎ আকারের (শত মিটার বা তারও বেশি) এবং এদের কক্ষপথ অনেক বেশি উপবৃত্তাকার। এই ডার্ক কমেটগুলো সাধারণত বৃহস্পতি পরিবারের ধূমকেতুর বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। দ্বিতীয় গোষ্ঠীটি হলো “অভ্যন্তরীণ ডার্ক কমেট”। এদের আকার অনেক ছোট (কয়েক দশ মিটার বা তারও কম) এবং এরা অভ্যন্তরীণ সৌরজগতের কাছাকাছি প্রায় গোলাকার কক্ষপথে ঘোরে।
এই আবিষ্কার নতুন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। ডার্ক কমেটগুলো কোথা থেকে এসেছে? কীভাবে এদের কক্ষপথে এমন অস্বাভাবিক গতি পরিবর্তন ঘটে? এরা কি বরফের মতো কোন পদার্থ বহন করে? পৃথিবীতে জীবনের উপাদান সরবরাহে ডার্ক কমেটের ভূমিকা ডার্ক কমেটের আবিষ্কার শুধু সৌরজগতের নতুন জ্ঞান অর্জনই নয়, বরং এরা পৃথিবীতে জীবনের উপাদান সরবরাহে ভূমিকা রেখেছে কিনা সে সম্পর্কেও প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। গবেষকদের মতে, ডার্ক কমেট এমন একটি সম্ভাব্য উৎস হতে পারে যা পৃথিবীতে জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান সরবরাহ করেছে। এদের পৃষ্ঠে থাকা উদ্বায়ী পদার্থগুলো পৃথিবীতে জৈব রাসায়নিক প্রক্রিয়ার সূচনা করতে পারে।
ডার্ক কমেট গবেষণার ভবিষ্যৎ গবেষণায় আরও ডার্ক কমেট আবিষ্কারের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা এই মহাজাগতিক বস্তুগুলোর প্রকৃতি এবং তাদের উৎস সম্পর্কে আরও ভালো ধারণা পাবেন। এই গবেষণাগুলি শুধু জ্যোতির্বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, বরং পৃথিবীতে জীবনের উৎপত্তি এবং সৌরজগতের গঠনের ইতিহাস সম্পর্কেও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রদান করবে।
আরও পড়ুনঃ ১১ বিলিয়ন বছরের মহাকাশ ইতিহাসের তত্ত্ব প্রকাশ করেছে ডিইএসআই (DESI)