সাম্প্রতি তিনটি ভিন্ন ধরণের নতুন সুপারকনডাক্টিভিটির উপাদানে আবিষ্কার করেছেন বিজ্ঞানীরা। এর মধ্যে দুটি উদাহরণ প্রচলিত তত্ত্বকে নতুন করে ভাবিয়েছে, এবং তৃতীয়টি প্রায় অপ্রত্যাশিতভাবে প্রথাগত ধারণাগুলোর বাইরে চলে গেছে। ১৯১১ সালে ডাচ বিজ্ঞানী হেইকে ক্যামেরলিংহ অনেস সর্বপ্রথম বিদ্যুৎ প্রবাহে প্রতিরোধ হ্রাসের এই বিশেষ ঘটনাটি পর্যবেক্ষণ করেন। সেই থেকে সুপারকনডাক্টিভিটি বিজ্ঞানীদের মুগ্ধ করে আসছে। এটি এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ইলেকট্রন একে অপরের সাথে জোড়া বাঁধে। ইলেকট্রনের পারস্পরিক বিকর্ষণ থাকা সত্ত্বেও কীভাবে তারা একত্রিত হয়, তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা আজও গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
এই গবেষণার পিছনে আরেকটি বড় কারণ হল প্রযুক্তিগত সম্ভাবনা। সুপারকনডাক্টিভিটি ব্যবহার করে এমআরআই মেশিন এবং শক্তিশালী কণার সংঘর্ষযন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। বিজ্ঞানীরা যদি সুপারকনডাক্টিভিটি কীভাবে কাজ করে তা পুরোপুরি বুঝতে পারেন তাহলে উপযুক্ত উপাদান এবং কোয়ান্টাম প্রভাবের মাধ্যমে ইলেকট্রনদের বিশেষ মিথস্ক্রিয়া সৃষ্টি করে সুপারকনডাক্টিভিটি উচ্চ তাপমাত্রায়ও অর্জন করা সম্ভব হবে। তাহলে বিদ্যুৎবিহীন গ্রিড এবং ম্যাগনেটিক লেভিটেশন যানবাহনের মতো প্রযুক্তিগত বিপ্লব ঘটতে পারে।
আরও পড়ুনঃ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন জিঙ্ক আয়োডিন ব্যাটারি তৈরি করেছে বিজ্ঞানীরা
নতুন আবিষ্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এগুলো ২ডি উপাদানের সাথে সম্পর্কিত। এসব উপাদান এতটাই নমনীয় যে বিজ্ঞানীরা এক ক্লিকেই এগুলোকে সুপারকনডাক্টর, ইনসুলেটর এবং আরও অন্যান্য ধরণের বৈশিষ্ট্যে রূপান্তরিত করতে পারেন। ২০১৮ সালে এমআইটির বিজ্ঞানী পাবলো জারিলো-হেরেরো প্রথমবার “ম্যাজিক অ্যাঙ্গেল” গ্রাফিন নামক একটি ২ডি উপাদানে সুপারকনডাক্টিভিটি পর্যবেক্ষণ করেন। গ্রাফিন কার্বনের একটি বিশেষ রূপ, যা বিশেষভাবে সাজালে ইলেকট্রনের গতি কমিয়ে দেয় এবং তাদের জোড়া বাঁধতে সহায়তা করে।
গ্রাফিন একটি দুর্দান্ত উপাদান যা খুবই পাতলা এবং শক্তিশালী। এটি একটি ২ডি হানিকম্ব ল্যাটিস আকারে সাজানো। জারিলো-হেরেরো দেখান যে একটি নির্দিষ্ট কোণে দুটি গ্রাফিন স্তর সাজালে সুপারকনডাক্টিভিটি দেখা দেয়। এই কোণটি “ম্যাজিক অ্যাঙ্গেল” নামে পরিচিত। গ্রাফিনের এই বৈশিষ্ট্য বিজ্ঞানীদের নতুন উপাদান আবিষ্কারের জন্য আরও উৎসাহিত করেছে।
এরপর বিজ্ঞানীরা ট্রানজিশন মেটাল ডাইক্যালকোজেনাইড (টিএমডি) নামক আরেকটি ২ডি উপাদানে সুপারকনডাক্টিভিটি আবিষ্কার করেন। কোরি ডিন এবং তার দল ২০২০ সালে এই উপাদানটি নিয়ে কাজ শুরু করেন। তাদের প্রথম গবেষণায় সুপারকনডাক্টিভিটির সম্ভাব্যতা দেখা গেলেও এটি নিশ্চিত করা যায়নি। তবে, চার বছরের প্রচেষ্টার পর তারা এটি প্রমাণ করতে সক্ষম হন। টিএমডি উপাদান একটি বিশেষ মোড় বা “টুইস্ট”-এর মাধ্যমে সুপারকনডাক্টিভিটি প্রদর্শন করে। এদিকে, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী জি শান এবং কিন ফাই মাক আরও একটি অভাবনীয় আবিষ্কার করেন। তারা দেখান যে টিএমডি-এর নির্দিষ্ট একটি ভিন্ন মোড়ে সুপারকনডাক্টিভিটি সম্ভব। এটি এতটাই ব্যতিক্রমী যে প্রচলিত তত্ত্বের সাথে মেলানো সম্ভব নয়। তারা বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরিবর্তন করে এই উপাদানে ইলেকট্রনগুলোর আচরণ নিয়ন্ত্রণ করেন এবং সুপারকনডাক্টিভিটি তৈরি করেন।
অন্যদিকে, গ্রাফিন নিয়ে গবেষণা অব্যাহত আছে। এমআইটির বিজ্ঞানী লং জু এর নেতৃত্বে একটি দল সম্প্রতি পাঁচ স্তরের গ্রাফিনে একটি ভিন্নধর্মী সুপারকনডাক্টিভিটি আবিষ্কার করেছেন। এই উপাদানটি এমন বৈশিষ্ট্য দেখিয়েছে যা আগে কোনো সুপারকনডাক্টরে দেখা যায়নি। এই ধরনের সুপারকনডাক্টর চিরাল সুপারকনডাক্টর নামে পরিচিত। এটি এমন একটি ঘটনা যেখানে ইলেকট্রনের জোড়াগুলো একই দিকে ঘোরে।
লং জু এবং তার দল প্রাকৃতিকভাবেই তৈরি হওয়া কিছু গ্রাফিন স্তর খুঁজে বের করেন। তারা এই উপাদানের বৈশিষ্ট্যগুলো বিশ্লেষণ করে দেখেন যে ইলেকট্রনের ঘূর্ণন বা “রোটেশন” সুপারকনডাক্টিভিটির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চিরাল সুপারকনডাক্টিভিটি বিজ্ঞানীদের কাছে এক নতুন সম্ভাবনা নিয়ে আসে। এটি দেখিয়েছে যে ইলেকট্রনের আচরণ পূর্বে যা ভাবা হতো তার চেয়ে অনেক বেশি জটিল।
সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে যে কৃত্রিম উপায়ে তৈরি ম্যাটেরিয়ালেও সুপারকনডাক্টিভিটি সম্ভব। ল্যাবরেটরিতে গবেষকরা মাল্টি-লেয়ার ম্যাটেরিয়াল নিয়ে কাজ করছেন। যেমন, কিছু গবেষক বিশেষ ধাতু এবং সেমিকন্ডাক্টর একত্রিত করে নতুন সুপারকনডাক্টর তৈরি করার চেষ্টা করছেন। এই উপকরণগুলোতে ইলেকট্রনের গতি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বিশেষ ন্যানোস্কেল স্ট্রাকচার ব্যবহার করা হয়।
আরেকটি গবেষণায়, ইলেকট্রনের কোয়ান্টাম বিহেভিয়ারের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। ইলেকট্রনদের মাঝে থাকা বিশেষ মিথস্ক্রিয়া এবং তাদের গঠিত কোয়ান্টাম অবস্থার বিশ্লেষণ থেকে সুপারকনডাক্টিভিটির নতুন দিক উন্মোচন হয়েছে। গবেষকরা মনে করেন যে এই কোয়ান্টাম প্রভাবকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে সুপারকনডাক্টিভিটি উচ্চতাপমাত্রায়ও সম্ভব হতে পারে।
বিজ্ঞানীদের মতে, ভবিষ্যতে এই গবেষণার ফলাফল নতুন প্রজন্মের ইলেকট্রনিক ডিভাইস তৈরিতে কাজে লাগানো যেতে পারে। সুপারকনডাক্টরের সাহায্যে আরও শক্তিশালী, দ্রুততর এবং কম শক্তি খরচ করা ডিভাইস তৈরি করা সম্ভব হবে। উদাহরণস্বরূপ, কোয়ান্টাম কম্পিউটিংয়ে সুপারকনডাক্টর একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
এইসব গবেষণার ফলে সুপারকনডাক্টিভিটি নিয়ে আমাদের বোঝাপড়া প্রতিনিয়ত উন্নত হচ্ছে। যদিও অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনো অজানা, তবে এটি নিশ্চিত যে সুপারকনডাক্টিভিটি ভবিষ্যতে বিজ্ঞানের অনেক বড় সাফল্যের দ্বার উন্মোচন করবে। ইলেকট্রনের মিথস্ক্রিয়া, নতুন উপাদান আবিষ্কার, এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে বিজ্ঞানীরা এই ক্ষেত্রকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সব মিলিয়ে, সুপারকনডাক্টিভিটি নিয়ে গবেষণা কেবল বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেই নয়, বরং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রযুক্তিতেও অভূতপূর্ব পরিবর্তন আনতে পারে। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যা বিজ্ঞানের নতুন সম্ভাবনার কথা জানান দিচ্ছে। ভবিষ্যতে এর ফলাফল কী হবে, তা আমরা কৌতূহলের সাথে অপেক্ষা করে দেখতে পারি।
আরও পড়ুনঃ নতুন ধরণের প্লাস্টিক উপাদান যা একইসঙ্গে প্রসারণযোগ্য, নমনীয়, পুনর্ব্যবহারযোগ্য এবং খরচ-সাশ্রয়ী