বিশ্বব্যাপী কম্পিউটার চিপ উন্নয়নের পথে নতুন অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা উল্টোদিক থেকে প্রবাহিত তাপমাত্রার সংকেত বিশ্লেষণ করে কম্পিউটার চিপে তাপ প্রবাহের কার্যকারিতা উন্নত করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। এই গবেষণা উত্কৃষ্ট চিপ তৈরি ও তাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। কম্পিউটার চিপ তৈরিতে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষত যখন ডিভাইসের আকার ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে, তখন তাপমাত্রা ব্যবস্থাপনা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন গেমিং কনসোল বা এআই চালিত ডেটা সেন্টারগুলোতে একটানা উচ্চ শক্তি প্রক্রিয়াকরণে তাপমাত্রা বৃদ্ধি একটি বড় বাধা সৃষ্টি করে। গবেষকরা কপার বা তামার মত অতি পাতলা ধাতুতে তাপ প্রবাহের কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণ করেন এবং একটি বিশেষ নিয়ম, ম্যাথিসেনের সূত্র, প্রয়োগের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন। এই সূত্রটি ইলেকট্রনের চলাচলে বিভিন্ন প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে তাপ প্রবাহের গতিবিধি নির্ধারণে সাহায্য করে।
আরও পড়ুনঃ সিগেট বাজার নিয়ে আসতে যাচ্ছে নতুন প্রযুক্তির এইচ.এ.এম.আর ড্রাইভ
গবেষক দল একটি বিশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করেছেন যার নাম ‘স্টেডি-স্টেট থার্মোরিফ্লেক্টেন্স’ (SSTR)। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা কপার ফিল্মের তাপ পরিবাহিতা মাপেন এবং একই সাথে এর বৈদ্যুতিক প্রতিরোধ ক্ষমতার তথ্য তুলনা করেন। এই পদ্ধতি ম্যাথিসেনের সূত্রের প্রমাণ প্রদান করেছে, যা প্রাথমিকভাবে বৃহৎ আকারের বস্তুতে প্রয়োগ করা হতো। কিন্তু এই প্রথমবার এটি ন্যানোস্কেলের অতি পাতলা তামার ফিল্মে সফলভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে। গবেষণার মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে যে ম্যাথিসেনের সূত্রের নির্ভুল প্রয়োগের মাধ্যমে ন্যানোস্কেলের তাপ প্রবাহ ব্যাখ্যা করা সম্ভব।
উল্লেখযোগ্যভাবে, বর্তমানের ভিএলএসআই (ভেরি-লার্জ-স্কেল ইন্টিগ্রেশন) প্রযুক্তিতে যেখানে অসংখ্য সার্কিট সংকীর্ণ জায়গায় স্থাপন করা হয়, সঠিক তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কার্যকারিতা উন্নত করা যায়। তাপমাত্রা সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে ডিভাইসগুলি ঠান্ডা এবং কার্যক্ষম থাকবে, যা শক্তি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। গবেষণার ফলাফল নির্দেশ করে, চিপ নির্মাতারা এখন একটি নির্ভরযোগ্য সূত্রের মাধ্যমে তাপের গতিবিধি পূর্বানুমান করতে পারবেন।
তামা তার চমৎকার তাপ এবং বৈদ্যুতিক পরিবাহিতার জন্য বহুল ব্যবহৃত একটি ধাতু। কিন্তু ন্যানোস্কেলের পাতলা স্তরে এর কার্যকারিতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে যায়। এতে তাপ প্রবাহের বাধা বৃদ্ধি পায় এবং শক্তি অপচয় ঘটে। গবেষকরা এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্য তাপ পরিবাহিতার তথ্য বিশ্লেষণ করেন এবং ম্যাথিসেনের সূত্রের মাধ্যমে একটি কার্যকর সমাধান খুঁজে পান।
এই গবেষণাটি কেবল আধুনিক চিপ প্রযুক্তির উন্নতিতেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং ভবিষ্যতে আরও শক্তি সাশ্রয়ী এবং উচ্চ কার্যক্ষম ডিভাইস তৈরির সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। গবেষণার ফলাফল বিশেষত সিএমওএস (কমপ্লিমেন্টারি মেটাল-অক্সাইড-সেমিকন্ডাক্টর) প্রযুক্তির উন্নতিতে ভূমিকা রাখবে। সিএমওএস প্রযুক্তি আধুনিক ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মূল ভিত্তি, যা কম্পিউটার, স্মার্টফোন, যানবাহন এবং চিকিৎসা যন্ত্রপাতিতে ব্যবহৃত হয়। গবেষণাটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইন্ডাস্ট্রির সহযোগিতার একটি সফল উদাহরণ। ইন্টেল এবং সেমিকন্ডাক্টর রিসার্চ কর্পোরেশনের সঙ্গে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে এই গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। একাডেমিক এবং শিল্পের মধ্যে এই ধরনের সহযোগিতা ইলেকট্রনিক্সের ভবিষ্যত উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
গুগল এর দাবি তারা মাল্টিভার্সকে সমর্থন করে এমন একটি কোয়ান্টাম চিপ তৈরি করেছে
তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে ম্যাথিসেনের সূত্রের প্রয়োগ ন্যানোস্কেলের প্রযুক্তিকে আরও কার্যকর করতে সাহায্য করবে। ভবিষ্যতে, এই উদ্ভাবনী পদ্ধতির সাহায্যে ডিভাইসগুলো আরও ঠান্ডা, দ্রুত এবং শক্তি সাশ্রয়ী হতে পারবে। উদাহরণস্বরূপ, সঠিক তাপ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে একটি গেমিং কনসোলের দীর্ঘস্থায়ী কার্যক্ষমতা বজায় রাখা যাবে এবং এর বিদ্যুৎ খরচ কমানো সম্ভব হবে। এছাড়াও, এআই ভিত্তিক ডেটা সেন্টারগুলোতে বিদ্যুৎ খরচ হ্রাস এবং তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদী কার্যকারিতা বাড়ানো যাবে।
এই গবেষণা একদিকে যেমন প্রযুক্তির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে, অন্যদিকে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার মান উন্নত করার জন্য নতুন পথ উন্মোচন করছে। ন্যানোস্কেলের তাপ ব্যবস্থাপনার এই সাফল্য ভবিষ্যতে আরও উন্নত প্রযুক্তি তৈরির পথে আমাদের এগিয়ে নিয়ে যাবে। আধুনিক প্রযুক্তির ক্ষেত্রে তাপ নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, এবং এই গবেষণা সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় একটি বড় পদক্ষেপ।
আরও পড়ুনঃ কম্পিউটার মানুষের ব্রেনের মতো কাজ করবে, মেমরিস্টর ও নিউরোমরফিক কম্পিউটিং