সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এমন একটি কোয়াজিপার্টিকেল আবিষ্কার করেছেন, যার ভর শুধু একটি নির্দিষ্ট দিকে চলার সময়ই থাকে এবং অন্যদিকে চলার সময় তা ভরহীন হয়ে যায়। এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্যের কোয়াজিপার্টিকেলটি প্রথমবারের মতো একটি বিশেষ ধরণের স্ফটিকের (ক্রিস্টাল) মধ্যে শনাক্ত করা হয়েছে। এই গবেষণা আধুনিক পদার্থবিদ্যায় একটি বড় পরিবর্তন আনতে পারে এবং এর ব্যবহার ভবিষ্যতে ব্যাটারি এবং সেন্সরের ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাতে পারে।
কোয়াজিপার্টিকেল হলো একাধিক উপপরমাণুক কণার সমষ্টি যা একসঙ্গে একটি কণার মতো আচরণ করে। সাধারণত ইলেকট্রন, প্রোটন বা ফোটনের মতো উপপরমাণুক কণাগুলোর ভর নির্দিষ্ট এবং অপরিবর্তনীয়। তবে, কোয়াজিপার্টিকেলের ক্ষেত্রে ভিন্ন ঘটনা ঘটে। এটি এমন এক প্রকার যৌথ কণা যা স্বতন্ত্র কণার চেয়ে অনেক বেশি জটিল আচরণ করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, এই নতুন আবিষ্কৃত কোয়াজিপার্টিকেলটি ভরহীন ফোটনের মতো একটি দিকে চলতে পারে এবং অন্যদিকে ভরের সঙ্গে চলতে পারে।
আরও পড়ুনঃ বিজ্ঞানীরা প্রোটনের ভেতরের জটিল সম্পর্কগুলোকে চিত্র আকারে দেখাতে সমর্থ হয়েছেন
২০০৮-০৯ সালে বিজ্ঞানীরা প্রথম “সেমি-ডিরাক ফার্মিয়ন” নামে একটি ধারণা প্রস্তাব করেছিলেন। এটি এমন একটি কণার ধারণা ছিল, যা একদিকে ভরযুক্ত এবং অন্যদিকে ভরহীন। এই ধারণা শুরুতে তাত্ত্বিক ছিল এবং এর বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ ছিল। কিন্তু, বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি জিরকোনিয়াম সিলিকন সালফাইড (ZrSiS) নামে পরিচিত একটি বিশেষ স্ফটিকের মধ্যে এই সেমি-ডিরাক ফার্মিয়নের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। এটি পদার্থবিদ্যায় একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার।
পেন স্টেট ইউনিভার্সিটির ড. ইয়িনমিং শাও এবং তার দল ZrSiS স্ফটিকের ওপর আলো ফেলানোর সময় এই অস্বাভাবিক কোয়াজিপার্টিকেলটি আবিষ্কার করেন। তারা একটি শক্তিশালী চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করে এবং ইনফ্রারেড আলো ব্যবহার করে স্ফটিকটির প্রতিফলিত আলোর বৈশিষ্ট্য পরীক্ষা করছিলেন। গবেষণার সময়, তারা দেখেন যে কিছু ইলেকট্রন অদ্ভুত আচরণ করছে, যা সেমি-ডিরাক ফার্মিয়নের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিলে যায়।
এই কোয়াজিপার্টিকেলের আচরণ ব্যাখ্যা করতে, ড. শাও এটি একটি ছোট ট্রেনের সঙ্গে তুলনা করেন। তিনি বলেন, “কণাটি এমন একটি ট্রেনের মতো যা নির্দিষ্ট একটি ট্র্যাকে দ্রুত গতিতে চলে। কিন্তু যখন এটি একটি সংযোগস্থলে এসে ভিন্ন ট্র্যাকে যেতে চায়, তখন এটি হঠাৎ ভর অর্জন করে এবং এর গতি কমে যায়।”
যখন কোয়াজিপার্টিকেলটি ভরহীন অবস্থায় থাকে, তখন এটি ফোটনের মতো আলো বা শক্তির দ্রুতগতিতে চলতে পারে। অন্যদিকে, যখন এটি ভর অর্জন করে, তখন এটি ইলেকট্রনের মতো কম গতিতে চলে এবং পদার্থের সঙ্গে যোগাযোগ করে। এই অদ্ভুত আচরণটি পদার্থবিদ্যার একটি সম্পূর্ণ নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন করেছে।
গবেষণার সময় দেখা গেছে যে চৌম্বক ক্ষেত্র প্রয়োগ করলে ইলেকট্রনগুলোর শক্তি স্তরের মধ্যে নির্দিষ্ট ফাঁক তৈরি হয়। সাধারণত, ভরযুক্ত কণার ক্ষেত্রে এই ফাঁক চৌম্বক ক্ষেত্রের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। কিন্তু ZrSiS স্ফটিকের ক্ষেত্রে, এই ফাঁক চৌম্বক ক্ষেত্রের ঘনমাত্রার দুই-তৃতীয়াংশ (B²/³) অনুপাতে বৃদ্ধি পায়, যা সেমি-ডিরাক ফার্মিয়নের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।
এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি প্রমাণ করে যে এই কোয়াজিপার্টিকেলটি বাস্তব এবং তাত্ত্বিক অনুমানের বাইরেও কার্যকর। গবেষকরা বলছেন, এটি নতুন উপকরণ এবং প্রযুক্তির বিকাশে নতুন দিকনির্দেশনা দিতে পারে। এই আবিষ্কার শুধুমাত্র তাত্ত্বিক গুরুত্বই বহন করে না, বরং এর ব্যবহারিক দিকও অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ZrSiS স্ফটিকের স্তরযুক্ত কাঠামো গ্রাফাইটের মতো। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, একক স্তরের ZrSiS কেটে ফেলে এর বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, যেমনটি গ্রাফিনের ক্ষেত্রে হয়েছে। এটি অত্যন্ত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যাটারি, সেন্সর এবং আরও অনেক অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
উদাহরণস্বরূপ, সেমি-ডিরাক ফার্মিয়নের ক্ষমতা ব্যবহার করে অত্যন্ত সংবেদনশীল সেন্সর তৈরি করা সম্ভব হবে, যা পরিবেশগত পরিবর্তন, তাপমাত্রা বা চৌম্বক ক্ষেত্র নির্ণয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। এছাড়া, ব্যাটারি প্রযুক্তিতে এর প্রয়োগ ব্যাটারির চার্জ ধারণক্ষমতা এবং স্থায়িত্ব বাড়াতে পারে।
যদিও এই গবেষণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, তবে অনেক প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে। ড. শাও বলেন, “আমরা যা দেখেছি তা সম্পূর্ণরূপে ব্যাখ্যা করা যায়নি। এর মধ্যে অনেক রহস্য রয়েছে, যা আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি।” বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, আরও গবেষণা করলে এই কোয়াজিপার্টিকেল সম্পর্কে আরও গভীরতর জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব হবে। একটি বড় চ্যালেঞ্জ হলো ZrSiS স্ফটিক থেকে একক স্তর তৈরি করা। এটি অত্যন্ত জটিল এবং সময়সাপেক্ষ একটি প্রক্রিয়া। তদ্ব্যতীত, এই কোয়াজিপার্টিকেলের বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ন্ত্রণ করা এবং সেগুলি ব্যবহারিক প্রযুক্তিতে রূপান্তর করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
সেমি-ডিরাক ফার্মিয়নের আবিষ্কার আধুনিক পদার্থবিদ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। এটি আমাদের মহাবিশ্বের ভৌত প্রকৃতি সম্পর্কে নতুন ধারণা প্রদান করেছে এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। গবেষণার এই ধারাবাহিকতা ভবিষ্যতে আরও গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার আনবে বলে আশা করা হচ্ছে। একদিকে ভরযুক্ত এবং অন্যদিকে ভরহীন কোয়াজিপার্টিকেলের এই অদ্ভুত বৈশিষ্ট্য আমাদের সামনে নতুন জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত প্রয়োগের অবারিত সুযোগ এনে দিচ্ছে। গবেষণা আরও অগ্রসর হলে, এটি কেবল পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রেই নয়, বরং প্রযুক্তি এবং শিল্পেও একটি বিপ্লব আনবে।
আরও পড়ুনঃ প্রথমবারের মতো বিজ্ঞানীরা নিউট্রনের ভেতরের গঠন সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন