মেডিটেশন এমন একটি অভ্যাস যা মানসিক সুস্থতা এবং শারীরিক অবস্থা উন্নত করতে সহায্য করে। বর্তমান যুগে, একে মানসিক চাপ কমানোর এবং মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর একটি শক্তিশালী টুল হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সম্প্রতি এক বৈজ্ঞানিক গবেষণায় এমন কিছু তথ্য প্রকাশ পেয়েছে, যা আমাদেরকে আরও বিস্মিত করে তুলেছে। গবেষকরা জানিয়েছেন যে, নিয়মিত মেডিটেশন অভ্যাসে থাকার ফলে মস্তিষ্কে এমন কিছু বিশেষ পরিবর্তন ঘটে, যা আমাদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এই গবেষণাটি বিজ্ঞানীদের ধারণাকে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। মেডিটেশন শুধুমাত্র মানসিক শান্তি নয়, মস্তিষ্কের কাজের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।
গবেষকরা জানাচ্ছেন, যেসব মানুষ নিয়মিত মেডিটেশন করেন, তাদের মস্তিষ্কের তরঙ্গের (ব্রেইন ওয়েব) প্যাটার্ন সাধারণ মানুষের থেকে ভিন্ন হয়ে থাকে, এমনকি যখন তারা বিশ্রামে থাকেন। এই গবেষণা মাইন্ডফুলনেস ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে, যেখানে ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাফি (EEG) প্রযুক্তির মাধ্যমে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের পরিবর্তন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষকরা দেখেছেন, মেডিটেশন অভ্যাসে থাকা মানুষের মস্তিষ্কের থিটা, আলফা এবং গামা ফ্রিকোয়েন্সি ব্যান্ডগুলিতে বিভিন্ন ধরনের পরিবর্তন দেখা যায়।
গবেষণাটি ৯২ জন স্বেচ্ছাসেবীর উপর পরিচালিত হয়, যাদের মধ্যে ৪৮ জন ছিলেন নিয়মিত মেডিটেশন অভ্যাসী এবং ৪৪ জন ছিলেন সাধারণ মানুষ। যেসব বিষয়গুলো খেয়াল রাখা হয়েছিল, তা হলো বয়স, লিঙ্গ এবং মানসিক স্বাস্থ্য স্থিতিশীলতা। মস্তিষ্কের তরঙ্গ পরিমাপের জন্য ইইজি প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা মস্তিষ্কের বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ পরিমাপ করে এবং এতে ৬৪টি চ্যানেল যুক্ত একটি ক্যাপ ব্যবহার করা হয়।
গবেষকরা মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো পরিমাপ করেছেন যখন অংশগ্রহণকারীরা চোখ খোলা ও বন্ধ রেখে বিশ্রামে ছিলেন। এই পদ্ধতির মাধ্যমে তারা মস্তিষ্কের স্থায়ী পরিবর্তনগুলো তুলে ধরেছেন, যা একদিকে মেডিটেশন অভ্যাসের সুফল এবং অন্যদিকে স্ট্রেস ও মানসিক চাপের জন্য উপকারী হতে পারে।
গবেষণার ফলাফল অনুযায়ী, মেডিটেশন অভ্যাসী মানুষের মস্তিষ্কে থিটা, আলফা এবং গামা তরঙ্গে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন দেখা গেছে।
- থিটা তরঙ্গ: এটি দৃষ্টি এবং স্মৃতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মেডিটেশন অভ্যাসীদের মস্তিষ্কে থিটা তরঙ্গের পরিমাণ বেশি ছিল, বিশেষ করে মস্তিষ্কের পশ্চাদভাগে (posterior regions)। এটি নির্দেশ করে যে, মেডিটেশন অভ্যাসীরা বেশি মনোযোগী এবং তথ্য প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে আরও কার্যকর।
- আলফা তরঙ্গ: সাধারণ মানুষের মস্তিষ্কে আলফা তরঙ্গ বেশি দেখা গিয়েছিল পশ্চাদভাগে, কিন্তু মেডিটেশন অভ্যাসীদের মস্তিষ্কে এটি ছিল অধিক ফ্রন্টাল অঞ্চলে (front regions)। এটি সম্ভবত নির্দেশ করে যে, মেডিটেশন অভ্যাসীরা অপ্রাসঙ্গিক বা বিভ্রান্তিকর চিন্তা নিয়ন্ত্রণে বেশি সক্ষম।
- গামা তরঙ্গ: গামা তরঙ্গ মস্তিষ্কের উচ্চতর কার্যক্রমের সাথে সম্পর্কিত, যেমন মনোযোগ এবং সংবেদনশীল তথ্যের প্রক্রিয়াকরণ। মেডিটেশন অভ্যাসীদের মস্তিষ্কে গামা তরঙ্গের পরিমাণ বেশি ছিল, যা শারীরিক এবং মানসিক কার্যকলাপের মধ্যে একত্রীকরণকে শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
টি ব্যাগ থেকে নির্গত মাইক্রোপ্লাস্টিক মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে আমাদের স্বাস্থ্যের
গবেষকরা এই তিনটি তরঙ্গে পরিবর্তন দেখেছেন, যা মস্তিষ্কের বিভিন্ন কার্যক্রমে বিভিন্ন উন্নতির সূচক হতে পারে। তারা জানান, এই পরিবর্তনগুলি সম্ভবত দীর্ঘমেয়াদী মেডিটেশন অভ্যাসের ফলস্বরূপ ঘটে, যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়াতে সহায়ক।
গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে, মেডিটেশন অভ্যাসের কারণে মস্তিষ্কের কার্যকলাপের কিছু মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। তাদের গবেষণায় কোনো সাধারণ বৃদ্ধি বা সমগ্র মস্তিষ্কের সব তরঙ্গে সমান পরিবর্তন দেখা যায়নি। মস্তিষ্কের কিছু অঞ্চলে বিশেষত থিটা, আলফা এবং গামা তরঙ্গে দৃশ্যমান পরিবর্তন হওয়ায় এটি বুঝা যাচ্ছে যে, এই তরঙ্গগুলো কাজের ক্ষেত্রে আরও বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।
তবে গবেষকরা নিশ্চিত করেছেন যে, মেডিটেশন অভ্যাসের কারণে কিছু সাধারণ বেটা তরঙ্গে কোনো পরিবর্তন হয়নি, যা সচেতনতা এবং সতর্কতার সাথে সম্পর্কিত। এটি নির্দেশ করে যে, মেডিটেশন অভ্যাস মানুষের মস্তিষ্কে কিছু বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ পরিবর্তন ঘটায়, তবে সব জায়গায় নয়।
যদিও এই গবেষণাটি শক্তিশালী ফলাফল দিয়েছে, তবে এটি কিছু সীমাবদ্ধতা রেখেছে। এটি একটি ক্রস-সেকশনাল গবেষণা, যার ফলে গবেষকরা নিশ্চিত হতে পারেননি যে, এটি শুধুমাত্র মেডিটেশন অভ্যাসের কারণেই ঘটেছে, নাকি যারা মেডিটেশন করছেন, তাদের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ এমনভাবেই ছিল।
তবে গবেষকরা জানান, তাদের পূর্ববর্তী গবেষণা এবং অন্যান্য গবেষণাগুলির সাহায্যে তারা ধরে নিতে পারেন যে, মেডিটেশন অভ্যাস মস্তিষ্কের কার্যকলাপে পরিবর্তন আনতে সহায়তা করে।
এই গবেষণা আমাদের আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে, যেখানে আমরা দেখতে পাচ্ছি মেডিটেশন শুধু মানসিক শান্তি এবং চাপ কমানোর জন্য নয়, এটি মস্তিষ্কের কার্যকলাপে গভীর পরিবর্তন আনতে পারে। এটি মানব মস্তিষ্কের কার্যকারিতা ও সুস্থতা নিয়ে আমাদের ধারণা আরও প্রসারিত করেছে।
“নেগেটিভ সময়” এটি কি সত্যি আছে? নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে কিছু আশ্চর্য তথ্য