প্লাস্টিক দূষণ আজকের পৃথিবীর একটি অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য পৃথিবীর ভূমি, সমুদ্র এবং এমনকি আমাদের শরীরে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার মাধ্যমে প্রবেশ করছে। এই প্লাস্টিক, যেগুলো পলিমার নামক বড় অণু দিয়ে তৈরি, সহজে পচে না। তাই এই বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এই সমস্যা সমাধানে, বিজ্ঞানীরা এমন এক ধরনের প্লাস্টিক তৈরি করেছেন যা ব্যাকটেরিয়া দিয়ে সহজেই পচনশীল এবং পরিবেশবান্ধব। গবেষকরা একটি নতুন ধরনের পরিবেশবান্ধব প্লাস্টিক কম্পোজিট তৈরি করেছেন, যা শক্তিশালী, কম খরচে উৎপাদনযোগ্য এবং সহজে ব্যাকটেরিয়া দ্বারা ভাঙা যায়। গবেষক দলটি এই নতুন উপাদান তৈরিতে দুটি প্রধান উপকরণ ব্যবহার করেছেন: হাইড্রোক্সি-ইথাইল সেলুলোজ এবং টাইরোসিন।
আরও পড়ুনঃ মারাত্মক ক্ষতিকর মাইক্রোপ্লাস্টিক কণার অন্যতম বড় উৎস গাড়ির টায়ার
প্লাস্টিকের প্রধান সমস্যা হলো এটি জৈব অবক্ষয় (বায়োডিগ্রেডেশন) প্রতিরোধ করে। যদিও বর্তমানে কিছু জৈবপচনশীল প্লাস্টিক তৈরি করা হচ্ছে, সেগুলোও বিশ্বব্যাপী প্লাস্টিক উৎপাদনের ২০%-এরও কম। তাছাড়া, জৈবপচনশীল প্লাস্টিক ভাঙার প্রক্রিয়াগুলো বেশ জটিল এবং ব্যয়বহুল। এই চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধানে ড. অ্যাঞ্জেলিকা নিয়াজভ-এলকান, ড. হাইম ওয়েইসম্যান এবং প্রফেসর বোরিস রিবচিনস্কি নেতৃত্বে একদল বিজ্ঞানী নতুন ধরনের কম্পোজিট প্লাস্টিক তৈরি করেছেন। তাদের এই উদ্ভাবন সম্প্রতি এসিএএস ন্যানো জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এই প্লাস্টিক তৈরির মূল উপাদান হলো হাইড্রোক্সি-ইথাইল সেলুলোজ, যা মূলত ওষুধ এবং প্রসাধন সামগ্রী তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। এটি একাই দুর্বল এবং সহজে গলে যায়। কিন্তু যখন এটি টাইরোসিন নামক একটি প্রাকৃতিক অ্যামিনো অ্যাসিডের সাথে মিশ্রিত করা হয়, তখন এটি একটি শক্তিশালী এবং টেকসই প্লাস্টিকে পরিণত হয়।
টাইরোসিন হলো একটি প্রচলিত অ্যামিনো অ্যাসিড, যা বিশেষ করে তার শক্তিশালী ন্যানোক্রিস্টাল গঠনের জন্য পরিচিত। গবেষকরা টাইরোসিন এবং হাইড্রোক্সি-ইথাইল সেলুলোজকে ফুটন্ত পানিতে মিশিয়ে একটি শক্তিশালী প্লাস্টিক তৈরি করেন। এই মিশ্রণটি ঠাণ্ডা হয়ে শুকিয়ে গেলে এর ভেতরে টাইরোসিন ন্যানোক্রিস্টালগুলো হাইড্রোক্সি-ইথাইল সেলুলোজে একীভূত হয়। ফলে একটি নতুন ধরনের শক্তিশালী কম্পোজিট প্লাস্টিক তৈরি হয়।
একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, মাত্র ০.০৪ মিলিমিটার পুরু এই প্লাস্টিকের একটি টুকরা ৬ কিলোগ্রাম ওজন বহন করতে পারে। এই শক্তির পাশাপাশি, নতুন প্লাস্টিকটি আগের চেয়ে বেশি নমনীয় (ডাকটাইল) হয়ে ওঠে, যা শিল্পক্ষেত্রে এর ব্যবহারকে আরও সম্ভাবনাময় করে তোলে। বর্তমানে বিভিন্ন শিল্পে কম্পোজিট প্লাস্টিকের ব্যবহার দিন দিন বাড়ছে। এই ধরনের প্লাস্টিক হালকা এবং শক্তিশালী হওয়ার কারণে এটি বিমান, গাড়ি এবং সাইকেলের মতো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের অংশ তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষকরা এই নতুন কম্পোজিট প্লাস্টিক তৈরি করার সময় এমন উপকরণ বেছে নিয়েছেন, যেগুলো সহজলভ্য, সস্তা এবং পরিবেশবান্ধব।
মানুষের মস্তিষ্কে সংখ্যা প্রক্রিয়াকরণের সঠিক স্থান নির্ণয় করেছেন বিজ্ঞানীরা
নতুন প্লাস্টিকটি শুধু শক্তিশালী নয়, বরং এটি বেশ নমনীয়ও। সাধারণত, কোনো উপাদান শক্তিশালী হলে তা নমনীয়তা হারায়। কিন্তু এই ক্ষেত্রে দুই উপাদান একত্রে একটি সমন্বয় তৈরি করেছে, যা উভয় গুণাবলী বজায় রাখতে সক্ষম। এর আরেকটি আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য হলো এটি সম্পূর্ণ জৈবপচনশীল এবং এমনকি খাওয়াও যেতে পারে। এই প্লাস্টিকের দুটি প্রধান উপাদান — সেলুলোজ এবং টাইরোসিন — উভয়ই প্রাকৃতিক এবং খাদ্য-গ্রহণযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ, টাইরোসিন প্রাকৃতিকভাবে কিছু শক্ত চীজে পাওয়া যায়। যদিও গবেষণাগারে তৈরি এই প্লাস্টিক এখনও খাওয়ার উপযোগী নয়, তবে ভবিষ্যতে এটি আরও উন্নত করা সম্ভব।
এই নতুন প্লাস্টিকটি পরীক্ষাগারে ফুটন্ত পানিতে মিশ্রিত করে তৈরি করা হয়েছে। তবে গবেষকরা এখন এই প্রক্রিয়াটি শিল্পক্ষেত্রে আরও উপযোগী করার জন্য কাজ করছেন। তারা বলছেন, ফুটন্ত পানির পরিবর্তে গলিত অবস্থায় পলিমার এবং টাইরোসিন মেশানোর নতুন পদ্ধতি অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এটি সফল হলে এই প্লাস্টিকটি বড় পরিসরে উৎপাদন করা যাবে এবং এটি শিল্পে ব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠবে। গবেষণার নেতৃত্বদানকারী প্রফেসর রিবচিনস্কি উল্লেখ করেছেন, “আমাদের লক্ষ্য হলো এই নতুন প্লাস্টিকের বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতাগুলো অতিক্রম করা। সফল হলে আমরা এটি বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন করতে পারব এবং প্লাস্টিক দূষণ রোধে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারব।”
এই নতুন প্লাস্টিক পরিবেশ সুরক্ষার পাশাপাশি শিল্পক্ষেত্রে একটি বড় পরিবর্তন আনতে সক্ষম। এটি শক্তিশালী, সস্তা এবং ব্যাকটেরিয়া দ্বারা সহজেই পচনশীল, যা বর্তমান প্লাস্টিক বর্জ্যের সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। ভবিষ্যতে এর উন্নত সংস্করণ ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হলে, এটি পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ক্ষেত্রে একটি যুগান্তকারী উদ্ভাবন হিসেবে বিবেচিত হবে।
আরও পড়ুনঃ আজব এক পাউডার যা কার্বন ডাই অক্সাইড (CO₂) শোষণ করতে পারে