টেসলা বর্তমানে চীনের বৈদ্যুতিক গাড়ির বাজারে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে নানা ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বৈদ্যুতিক যানবাহন নির্মাতাদের মধ্যে অন্যতম টেসলা, কিন্তু চীনের বাজারে তাদের প্রতিযোগিতা দিন দিন বাড়ছে। চীনের স্থানীয় নির্মাতারা যেমন বিওয়াইডি, এক্সপেং, এবং শাওমি বৈদ্যুতিক যানবাহনের নতুন নতুন মডেল এনে টেসলার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা কঠিন করে তুলেছে। ২০২২ সালে যেখানে টেসলার বাজার অংশীদারিত্ব ১৬ শতাংশের বেশি ছিল, তা ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে নেমে এসেছে মাত্র ৪.৩ শতাংশে। এই পরিস্থিতি সামাল দিতে টেসলা মডেল ওয়াই-এর একটি সস্তা সংস্করণ বাজারে আনার পরিকল্পনা করছে এবং চীনের স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং প্রযুক্তির সঙ্গে আরও ভালোভাবে সামঞ্জস্য রাখতে সফটওয়্যার উন্নয়নের দিকে নজর দিচ্ছে।
নতুন মডেল ওয়াই সংস্করণটি বর্তমানে বাজারে থাকা মডেলগুলোর তুলনায় ২০ শতাংশ কম দামে বিক্রি করা হবে। বর্তমানে মডেল ওয়াই-এর মূল্য ২৬৩,৫০০ ইউয়ান (৩৬,৪০৬ মার্কিন ডলার) থেকে ৩০৩,৫০০ ইউয়ানের মধ্যে, আর নতুন সংস্করণের দাম হবে আরও কম। এই নতুন মডেলটি সাংহাইতে অবস্থিত টেসলার গিগাফ্যাক্টরিতে উৎপাদিত হবে এবং ২০২৫ সাল থেকে বাজারে আসবে। টেসলার লক্ষ্য হল কম খরচে উচ্চমানের বৈদ্যুতিক যানবাহন সরবরাহ করে চীনের ক্রেতাদের আকৃষ্ট করা, যাতে তারা স্থানীয় প্রতিযোগীদের থেকে আবার বাজার দখল করতে পারে।
এছাড়াও, টেসলা তাদের স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং প্রযুক্তি আরও উন্নত করতে চীনের বাইদু কোম্পানির সঙ্গে কাজ করছে। বাইদুর ম্যাপিং সিস্টেম এবং রাস্তার চিহ্ন শনাক্তকরণ প্রযুক্তি টেসলার স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং সফটওয়্যারের সঙ্গে আরও ভালোভাবে মিলিয়ে কাজ করবে। এর ফলে চীনের ট্রাফিক সিস্টেমের সঙ্গে টেসলার গাড়িগুলো আরও কার্যকরভাবে সামঞ্জস্য রাখতে পারবে। তবে এই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে টেসলা তাদের স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং সফটওয়্যারকে চীনের বাজারে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারবে কি না, তা এখনও দেখার বিষয়।
টেসলার জন্য বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে অন্যতম হল স্থানীয় কোম্পানিগুলোর নতুন মডেল এবং কম খরচের বৈদ্যুতিক গাড়ি। উদাহরণস্বরূপ, এক্সপেংয়ের মোনা এম০৩ নামের একটি মডেলের প্রাথমিক মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১১৯,৮০০ ইউয়ান, যা টেসলার মডেল ৩-এর তুলনায় প্রায় অর্ধেক দাম। এই ধরনের প্রতিযোগিতামূলক মূল্য নির্ধারণ চীনের ক্রেতাদের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করছে। উপরন্তু, চীনের বাজারে একের পর এক নতুন বৈদ্যুতিক গাড়ির মডেল আসছে এবং এসব গাড়িতে উন্নত প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে, যার ফলে টেসলার বিক্রয় কমে যাচ্ছে।
২০২৪ সালে চীনের গাড়ির বাজারে প্রচুর মূল্যছাড় লক্ষ্য করা গেছে। মোট ২২৭টি গাড়ির মডেলের দাম কমানো হয়েছে, যেখানে ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ১৪৮টি এবং ২০২২ সালে মাত্র ৯৫টি গাড়ির মূল্য হ্রাস করা হয়েছিল। এটি দেখায় যে ক্রেতারা এখন গাড়ির জন্য অপেক্ষা করছেন, যাতে তারা আরও সাশ্রয়ী মূল্যে উন্নত গাড়ি কিনতে পারেন। এই পরিস্থিতি টেসলার জন্য আরও চ্যালেঞ্জের সৃষ্টি করছে, কারণ তারা একদিকে তাদের লাভজনকতা বজায় রাখতে চায়, অন্যদিকে বাজার দখল করতেও আগ্রহী।
চীনের বাজার টেসলার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরেই টেসলার দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার। সাংহাই গিগাফ্যাক্টরি টেসলার সবচেয়ে বড় উৎপাদন কেন্দ্র এবং এখান থেকে প্রচুর গাড়ি উৎপাদন ও সরবরাহ করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে টেসলার বিক্রয় পরিসংখ্যান আশানুরূপ নয়। ২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে সাংহাই গিগাফ্যাক্টরি থেকে টেসলা মাত্র ৩০,৬৮৮টি গাড়ি সরবরাহ করেছে, যা আগের মাসের তুলনায় ৫১.৫ শতাংশ এবং আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৪৯.২ শতাংশ কম। এই সংখ্যা ২০২২ সালের জুলাইয়ের পর থেকে সর্বনিম্ন।
টেসলার জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হল স্থানীয় কোম্পানিগুলোর প্রযুক্তিগত উন্নতি। এখন চীনে এমনকি ১০০,০০০ ইউয়ানের কম দামের গাড়িতেও স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। ২০২৫ সালে চীনে প্রায় ১৫ মিলিয়ন নতুন গাড়িতে স্বয়ংক্রিয় ড্রাইভিং প্রযুক্তি থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে, যা টেসলার জন্য প্রতিযোগিতা আরও কঠিন করে তুলবে। এরই মধ্যে টেসলা চীনের বাজারে তাদের নতুন “ফুল সেলফ-ড্রাইভিং” সফটওয়্যার চালু করেছে, যার মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৬৪,০০০ ইউয়ান। তবে এই প্রযুক্তি চীনের ক্রেতাদের মধ্যে কতটা জনপ্রিয় হবে, তা সময়ই বলে দেবে।
এছাড়া, টেসলার দুর্বল বিক্রয়ের একটি কারণ হতে পারে কোম্পানির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইলন মাস্কের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড। ইউরোপ ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারেও টেসলার বিক্রয় কমেছে, কারণ অনেক গ্রাহক মাস্কের রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে টেসলার গাড়ি কেনা থেকে বিরত থাকছেন। যদিও এটি সরাসরি চীনের বাজারের জন্য কতটা প্রভাব ফেলছে, তা পরিষ্কার নয়, তবে এটি টেসলার সামগ্রিক বিক্রয়ে প্রভাব ফেলতে পারে।
২০২৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে টেসলা মডেল ওয়াই-এর নতুন সংস্করণ চীনের বাজারে এসেছে, কিন্তু সাংহাইয়ের অনেক ক্রেতা এখনও গাড়ি হাতে পাননি, কারণ উৎপাদন সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ডেলিভারিতে বিলম্ব হচ্ছে। এটি টেসলার ক্রেতাদের হতাশ করতে পারে এবং তারা বিকল্প হিসেবে স্থানীয় কোম্পানির গাড়ির দিকে ঝুঁকতে পারেন।
সামগ্রিকভাবে, টেসলার জন্য চীনের বাজারে টিকে থাকা ক্রমেই কঠিন হয়ে পড়ছে। বাজার দখলে রাখতে প্রতিষ্ঠানটি নতুন মডেল আনার পাশাপাশি প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। তবে চীনের স্থানীয় কোম্পানিগুলোর অগ্রগতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হলে টেসলাকে আরও নতুনত্ব আনতে হবে এবং প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে গাড়ি সরবরাহ করতে হবে।
আমাজন থেকে এখন গাড়িও কেনা যাবে : আমাজন চালু করেছে নতুন সেবা “আমাজন অটোস”