গণিত আমাদের জীবনে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এটি কেবল প্রতিদিনের হিসাব-নিকাশে সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবজাতির জ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতিতে অপরিহার্য। সম্প্রতি ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির একদল গবেষক মানুষের মস্তিষ্কে এমন একটি অংশের সন্ধান পেয়েছেন, যা আমাদের সংখ্যাতাত্ত্বিক চিন্তাভাবনার প্রাথমিক উৎস হতে পারে। এই গবেষণার ফলাফল আমাদের শিক্ষা এবং নিউরোসার্জারি পদ্ধতিতে নতুন সম্ভাবনার পথ খুলে দিবে।
গবেষণার মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের মস্তিষ্কে সংখ্যা প্রক্রিয়াকরণের সঠিক স্থান নির্ণয় করা। এর জন্য ১৩ জন মৃগীরোগীকে নির্বাচিত করা হয়, যাদের উপর স্টেরিওট্যাকটিক ইলেক্ট্রোএনসেফালোগ্রাফি (এসইইজি) নামে একটি পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিতে রোগীদের মস্তিষ্কে বিদ্যুৎ তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ করা হয়, যা রোগের সঠিক স্থান চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। গবেষকরা রোগীদের বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেন, যেখানে তারা সংখ্যাকে প্রতীক, শব্দ এবং ধারণা হিসেবে ভাবতে বলেন। উদাহরণস্বরূপ, তিন সংখ্যাটি প্রতীক (৩), শব্দ (“তিন”) এবং ধারণা (তিনটি বিন্দু) হিসেবে ভাবতে বলা হয়।
আরও পড়ুনঃ স্পর্শ ছাড়ায় বস্তু স্থানান্তর করা যাবে কিরিগামি ডিজাইন এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করে
এমনকি মস্তিষ্কের উপর কাজ করার সময় একটি অপ্রত্যাশিত স্থান থেকে সাড়া পাওয়া যায় — পুটামেন। এটি মস্তিষ্কের গভীরে অবস্থিত একটি অংশ, যা সাধারণত চলাচল এবং মৌলিক কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত। এটি মানুষের উচ্চতর চিন্তা বা গাণিতিক সমস্যার সমাধানের মতো কাজের সঙ্গে খুব একটা সম্পর্কিত নয়। সাধারণত, চিন্তা এবং বিমূর্ত চিন্তার জন্য সেরিব্রাল কর্টেক্সকে দায়ী করা হয়, যা মস্তিষ্কের বাইরের স্তরজুড়ে অবস্থিত। তবে এই গবেষণা থেকে বোঝা যায়, সংখ্যার ধারণা মস্তিষ্কের একটি গভীর স্তরে প্রোথিত, যা আমাদের বিবর্তনের প্রাথমিক পর্যায়ে অর্জিত।
গবেষক ড. আহমেদ রাসলান উল্লেখ করেন, “মানুষের মস্তিষ্কে সংখ্যাকে বোঝার ক্ষমতা বিবর্তনের একেবারে শুরুর দিকেই তৈরি হয়েছে। এটি একটি গভীর এবং মৌলিক ক্ষমতা, যা আমাদের বর্তমান অবস্থানে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।”
গবেষণায় আরও দেখা গেছে যে, পুটামেন ছাড়াও মস্তিষ্কের ভিজ্যুয়াল এবং অডিটরি ইনপুট প্রসেসিং এলাকাগুলিতে কার্যক্রম লক্ষ্য করা যায়। একই সঙ্গে, প্যারিয়েটাল লোবেও সক্রিয়তা দেখা গেছে, যা সংখ্যাগত এবং গাণিতিক কাজের সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে যুক্ত। এই ফলাফলগুলো শুধু মানুষের চিন্তার বিকাশ বোঝাতেই সাহায্য করে না, বরং নিউরোসার্জারি পদ্ধতির জন্যও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিউরোসার্জারি বিশেষজ্ঞরা মস্তিষ্কের এই বিশেষ এলাকাগুলো চিহ্নিত করে তা এড়িয়ে যেতে পারবেন, যাতে অপারেশনের সময় গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোর ক্ষতি না হয়। উদাহরণস্বরূপ, টিউমার অপসারণ বা মৃগীরোগের কেন্দ্রবিন্দুতে কাজ করার সময়, মস্তিষ্কের সংখ্যা প্রক্রিয়াকরণ এলাকাগুলোকে রক্ষা করা যেতে পারে।
ড. আলেকজান্ডার রকহিল, গবেষণার প্রধান লেখক এবং ড. রাসলানের ল্যাবে পোস্টডক্টরাল গবেষক, বলেন, “মস্তিষ্কের সংখ্যার প্রক্রিয়াকরণের এলাকাগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করা গেলে অপারেশনের সময় সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। এটি রোগীদের জন্য আরও সুরক্ষিত এবং কার্যকরী চিকিৎসা নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।” এই গবেষণার জন্য রোগীদের স্বেচ্ছাসেবার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সহ-লেখক এবং ওরেগন হেলথ অ্যান্ড সায়েন্স ইউনিভার্সিটির নিউরোসার্জারির আবাসিক চিকিৎসক ড. ক্রিশ্চিয়ান লোপেজ রামোস বলেন, “আমাদের মৃগীরোগীরা তাদের সার্জারির সময় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে আমাদেরকে সাহায্য করেছেন। এটি আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ এবং বর্তমান কার্যপ্রণালী বোঝার ক্ষেত্রে একটি বিশাল অগ্রগতি এনে দিয়েছে।”
এই গবেষণা পূর্ববর্তী মস্তিষ্ক মানচিত্রায়ন গবেষণার ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছে। ড. রাসলান উল্লেখ করেন, “মানব মস্তিষ্ক এবং মনের কার্যপ্রণালী বুঝতে আমরা যদি সঠিক প্রশ্ন করতে পারি, তবে অসাধারণ তথ্য আবিষ্কার করা সম্ভব।” গবেষণার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য হলো মস্তিষ্কের অন্যান্য উচ্চতর কার্যক্ষমতার সুনির্দিষ্ট এলাকাগুলো চিহ্নিত করা। এটি কেবল শিক্ষার ক্ষেত্রে নয়, বরং বিভিন্ন নিউরোলজিক্যাল সমস্যার সমাধানেও সাহায্য করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যারা গাণিতিক সমস্যা বুঝতে অসুবিধা অনুভব করেন, তাদের জন্য বিশেষভাবে এই মস্তিষ্কের এলাকাগুলোতে কাজ করে শেখার পদ্ধতি উন্নত করা সম্ভব হতে পারে।
সারসংক্ষেপে বলা যায়, মস্তিষ্কের পুটামেন অংশে সংখ্যার ধারণা চিহ্নিত করার মাধ্যমে গবেষকরা এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এটি মানব বিবর্তনের একটি গভীর দিক প্রকাশ করে এবং শিক্ষা, চিকিৎসা এবং প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অমূল্য ভূমিকা রাখতে পারে। এই গবেষণা ভবিষ্যতে আমাদের মস্তিষ্কের গাণিতিক এবং অন্যান্য উচ্চতর দক্ষতা নিয়ে আরও গভীরতর গবেষণার পথ সুগম করবে।