মহাবিশ্বের অসীম সীমানা ও অজানা আরো অনেক তথ্য জানুন কি কেন ও কিভাবে

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের আকার ও প্রকৃতি সম্পর্কে মানুষের ধারণা ১৯২০-এর দশকের আগে ছিল খুবই সীমিত। আমরা বিশ্বাস করতাম যে আমাদের মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিই গোটা মহাবিশ্ব। কিন্তু একজন মহাকাশ বিজ্ঞানী, এডউইন হাবল, একটি তারার সাহায্যে এই ধারণা ভেঙে দেন এবং প্রমাণ করেন যে মহাবিশ্ব শুধু একটি গ্যালাক্সি নয়, বরং এর বাইরেও রয়েছে অসংখ্য গ্যালাক্সি। এই ঐতিহাসিক আবিষ্কার বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি চিরতরে পাল্টে দিয়েছে।

১৯২৩ সালে, এডউইন হাবল ক্যালিফোর্নিয়ার মাউন্ট উইলসন অবজারভেটরির ১০০ ইঞ্চি হুকার টেলিস্কোপ ব্যবহার করে আন্ড্রোমেডা নেবুলার একটি বিশেষ তারাকে চিহ্নিত করেন। এই তারা ছিল সেফেইড ভ্যারিয়েবল, একটি বিশেষ প্রজাতির তারা যা নির্দিষ্ট সময় অন্তর উজ্জ্বলতা পরিবর্তন করে। হেনরিয়েটা সোয়ান লিভিটের আগের গবেষণা দেখিয়েছে যে সেফেইড তারার উজ্জ্বলতার সঙ্গে তাদের পলসেশন পিরিয়ডের সম্পর্ক রয়েছে। এই সম্পর্ককে ব্যবহার করে একটি তারার প্রকৃত উজ্জ্বলতা এবং সেখান থেকে তার দূরত্ব নির্ধারণ করা সম্ভব।

আরও পড়ুনঃ ব্ল্যাক হোল কি কেন ও কিভাবে? ব্ল্যাক হোল এর পুরো ইতিহাস

আন্ড্রোমেডা নেবুলার দূরত্ব নির্ধারণ

যখন হাবল এই তারাটির দূরত্ব পরিমাপ করেন, তখন তিনি দেখেন যে এটি আমাদের গ্যালাক্সির বাইরেও অনেক দূরে অবস্থিত, প্রায় ২.২ মিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। এই আবিষ্কার স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে যে আন্ড্রোমেডা কোনো নেবুলা নয়, বরং একটি সম্পূর্ণ গ্যালাক্সি। এর অর্থ হলো, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি কেবল মহাবিশ্বের একটি ক্ষুদ্র অংশ, আর মহাবিশ্বের আকার আমাদের কল্পনার চেয়েও অনেক বড়।

মহাবিশ্বের প্রসারণ আবিষ্কার

এডউইন হাবল কেবল একটি গ্যালাক্সি আবিষ্কার করেই থেমে থাকেননি। তিনি আরও দেখান যে গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। ভেস্তো স্লাইফার নামের আরেকজন বিজ্ঞানী এর আগেই দেখিয়েছিলেন যে গ্যালাক্সিরা রেডশিফট দেখাচ্ছে, অর্থাৎ তারা দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু হাবল প্রথম দেখান যে গ্যালাক্সির রেডশিফট তাদের দূরত্বের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। এই সম্পর্ককে আমরা এখন হাবল-লেমেত্র আইন বলে জানি। এর মাধ্যমে প্রমাণিত হয় যে মহাবিশ্ব স্থির নয়, বরং এটি প্রসারিত হচ্ছে।

কসমোলজির নতুন যুগের সূচনা

হাবলের এই আবিষ্কার কসমোলজির ক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটায়। মানুষের কাছে মহাবিশ্ব ছিল একটি অনন্ত ও অপরিবর্তনীয় স্থানের ধারণা। কিন্তু হাবল দেখান যে এটি একটি পরিবর্তনশীল কাঠামো, যা একটি নির্দিষ্ট সময় আগে শুরু হয়েছে। এর ফলে “বিগ ব্যাং” তত্ত্বের জন্ম হয়, যা বলে যে মহাবিশ্ব এক সময় একটি অতি ঘন ও গরম বিন্দু থেকে বিস্ফোরিত হয়ে প্রসারিত হয়েছে।

হাবল টেলিস্কোপের যুগ

এডউইন হাবলের কাজের প্রতি সম্মান জানিয়ে ১৯৯০ সালে নাসা পৃথিবীর কক্ষপথে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ স্থাপন করে। এই টেলিস্কোপ মহাবিশ্বের আরও গভীরে নজর দেওয়ার সুযোগ দেয়। এটি অসংখ্য গ্যালাক্সি, নক্ষত্র এবং ব্ল্যাক হোলের চমকপ্রদ ছবি তুলেছে। এর সাহায্যে আমরা মহাবিশ্বের বয়স নির্ধারণ করতে পেরেছি—১৩.৮ বিলিয়ন বছর।

মহাবিশ্বের এক বিশালতা

আজ আমরা জানি, মহাবিশ্বে শত শত বিলিয়ন গ্যালাক্সি রয়েছে, প্রতিটিতে শত কোটি নক্ষত্র। এটি কেবল একটি ধারণা নয়, বরং একটি বাস্তবতা যা আমাদের বিজ্ঞানীরা নিরলস প্রচেষ্টায় আবিষ্কার করেছেন। এই বিশালতার মধ্যে আমাদের পৃথিবী ও সূর্য কেবলমাত্র একটি বিন্দু।

এডউইন হাবলের কাজ দেখিয়েছে যে বিজ্ঞান কেবল আমাদের জানার সীমানা বাড়ায় না, এটি আমাদের কৌতূহল এবং ভাবনার জগতকেও প্রসারিত করে। তাঁর আবিষ্কার আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা একটি অতি বিশাল মহাবিশ্বের অংশ, এবং আমরা এখনো এর বেশিরভাগ অজানা অংশ আবিষ্কার করার পথে আছি।

মহাবিশ্বের বিশালতা বোঝার জন্য বাস্তব কিছু উদাহরণ

  • ধরুন, আপনি একটি বালির দানা হাতে তুলে নিলেন। এখন যদি আপনি পৃথিবীর সমস্ত বালির কণা একসঙ্গে গুণতে যান, সেগুলোর সংখ্যা হবে অগণিত। তবে গবেষণাগার ও মহাকাশ পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ধারণা দেন যে মহাবিশ্বে যত নক্ষত্র আছে, তার সংখ্যা পৃথিবীর সমস্ত বালির কণার চেয়েও বেশি।
  • এখন আরেকটি উদাহরণ ভাবুন- আপনি রাতের আকাশে তাকিয়ে যে তারাগুলো দেখতে পান, সেগুলো আসলে আমাদের গ্যালাক্সি, মিল্কিওয়ে’র মাত্র একটি ক্ষুদ্র অংশ। কিন্তু মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি নিজেই একটি বিশাল গ্যালাক্সি যেখানে রয়েছে প্রায় ১০০ থেকে ৪০০ বিলিয়ন নক্ষত্র। আর এমন গ্যালাক্সি আমাদের মহাবিশ্বে শত শত বিলিয়ন রয়েছে।
  • মহাবিশ্ব এত বড় যে, আপনি যদি আলোর গতিতে (প্রতি সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার) ভ্রমণ করেন, তবুও একটি গ্যালাক্সি থেকে অন্য গ্যালাক্সিতে পৌঁছাতে আপনার লাখ লাখ বছর লেগে যাবে। উদাহরণস্বরূপ, আমাদের কাছাকাছি আন্ড্রোমেডা গ্যালাক্সি, যা আলোর গতিতে ভ্রমণ করেও পৌঁছাতে প্রায় ২.৫ মিলিয়ন বছর লেগে যাবে।

এই বিশালতাকে চিন্তা করার জন্য আমাদের দৈনন্দিন ধারণার বাইরে যেতে হয়, কারণ এটি এমন একটি ব্যাপ্তি যা আমাদের কল্পনাকেও ছাড়িয়ে যায়।

১১তম ডাইমেনশন কি? ডাইমেনশনের মাধ্যমে কিভাবে মহাবিশ্বকে ব্যাখ্যা করা যায়?

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো