১৯৮০-এর দশকের শেষ দিকে, নাসার ভয়েজার ২ মহাকাশযান যখন সৌরজগতের বাহিরের অঞ্চলে যাত্রা করছিল, তখন এটি একটি অদ্ভুত বিষয় লক্ষ্য করেছিল। সৌরজগতের বরফের দুই বৃহৎ গ্রহ, ইউরেনাস এবং নেপচুনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা তথাকথিত “ডাইপোল চুম্বক ক্ষেত্র” এর অভাব রয়েছে। এ ব্যাপারটি আমাদের নিজস্ব পৃথিবী এবং বৃহস্পতি ও শনির মত গ্যাস দানবদের ক্ষেত্রের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
পৃথিবীর মত গ্রহে ডাইপোল চুম্বক ক্ষেত্র তৈরির জন্য অভ্যন্তরীণ তাপীয় পরিবর্তন ও ঘূর্ণন খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সাধারণত গ্রহের পৃষ্ঠের কাছাকাছি ঘন পদার্থগুলো ঠাণ্ডা হয়ে অভ্যন্তরে তলিয়ে যায়, অন্যদিকে অভ্যন্তরের গরম পদার্থগুলো উপরে উঠতে থাকে। এই প্রক্রিয়ার ফলে, গ্রহের অভ্যন্তরে সংমিশ্রণ ও ঘূর্ণন ঘটে, যা গ্রহের অভ্যন্তরীণ পদার্থের চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে। পৃথিবীর ক্ষেত্রে, এই প্রক্রিয়া পৃথিবীর চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে যা আমাদেরকে সৌর কণা থেকে রক্ষা করে।
আরও পড়ুনঃ ডার্ক ম্যাটার : পাথরের ভিতর থেকে মহাবিশ্বের অজানা রহস্যের সন্ধান
কিন্তু ইউরেনাস এবং নেপচুনের ক্ষেত্রে এই চুম্বকীয় প্রক্রিয়া নেই। বিজ্ঞানীরা তখন থেকে একটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজছিলেন: কেন এই দুই গ্রহে এমনটি ঘটে না? গত দুই দশক ধরে গবেষকরা অনুমান করেছিলেন যে এই সমস্যার কারণ হচ্ছে এই গ্রহগুলোর অভ্যন্তরে পদার্থের স্তরগুলো মিশ্রিত হতে পারে না, ফলে অভ্যন্তরীণ সংমিশ্রণ বন্ধ হয়ে যায় এবং ডাইপোল চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় না। তবে এই স্তরগুলোর প্রকৃতি ও গঠন নিয়ে গবেষকরা একমত হতে পারেননি।
ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রহ বিজ্ঞানী বুরখার্ড মিলিতজার অবশেষে একটি সমাধানের কাছে পৌঁছেছেন বলে মনে করছেন। তার মতে, “আমাদের এখন একটি ভালো ধারণা আছে কেন ইউরেনাস এবং নেপচুনের চুম্বক ক্ষেত্রগুলি অন্যান্য গ্রহের থেকে এতটা আলাদা।” মিলিতজার মতে, ইউরেনাস এবং নেপচুনের মধ্যে একাধিক স্তর রয়েছে যা মিশ্রিত হয় না, যার ফলে এই ডাইপোল চুম্বক ক্ষেত্র গঠিত হতে পারে না। এই স্তরগুলো গ্রহের চুম্বকীয় কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে এবং এটিই মূল কারণ যে কেন এই গ্রহগুলোর চুম্বক ক্ষেত্র পৃথিবী, বৃহস্পতি বা শনির মত নয়।
দশ বছর আগে, মিলিতজার এই দুই গ্রহের অভ্যন্তর গঠনের একটি কম্পিউটার সিমুলেশন করেছিলেন। তিনি কার্বন, অক্সিজেন, নাইট্রোজেন এবং হাইড্রোজেনের প্রায় ১০০টি পরমাণু একত্রে চাপ ও তাপমাত্রার অধীনে স্থাপন করেছিলেন, যা এই দুই গ্রহের অভ্যন্তরের অবস্থা অনুকরণ করে। কিন্তু সেই সময়ে, কোনো নির্দিষ্ট স্তর দেখা যায়নি। তবে গত বছর মিলিতজার মেশিন লার্নিংয়ের সাহায্যে প্রায় ৫৪০টি পরমাণুর একটি সিমুলেশন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং সেখানে দেখা গেছে যে, স্তরগুলো প্রাকৃতিকভাবে গঠিত হচ্ছে। “একদিন আমি মডেলটি দেখে দেখলাম যে পানির স্তর কার্বন এবং নাইট্রোজেন থেকে আলাদা হয়ে গেছে,” মিলিতজার বললেন। “যা আমি দশ বছর আগে করতে পারিনি, তা এখন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ঘটছে।”
মিলিতজারের মতে, ইউরেনাসের ৩০০০ মাইল পুরু বায়ুমণ্ডলের নিচে প্রায় ৫০০০ মাইল গভীর পানির স্তর রয়েছে এবং তার নিচে আরও একটি ৫০০০ মাইল পুরু হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ স্তর রয়েছে। এই স্তরগুলোর নিচে পারদের আকারের একটি পাথুরে কেন্দ্র রয়েছে। এই স্তরগুলো তাদের ঘনত্বের কারণে পৃথক থাকে। পানির স্তর অপেক্ষাকৃত হালকা এবং তা উপরের দিকে থাকে, যেখানে কার্বন এবং হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ স্তর নিচের দিকে থাকে। এই কারণে, কোনো ধরনের অভ্যন্তরীণ মিশ্রণ বা সংমিশ্রণ ঘটে না এবং চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি হয় না।
নেপচুনের ক্ষেত্রেও অনুরূপ ঘটনা ঘটে। এটি ইউরেনাস থেকে বেশি ভরের হলেও, এর মোট ব্যাস ছোট এবং বায়ুমণ্ডল পাতলা। তবে এর মধ্যে সমানভাবে পৃথক পানি-সমৃদ্ধ এবং হাইড্রোকার্বন-সমৃদ্ধ স্তর রয়েছে এবং এর কেন্দ্রে মঙ্গল গ্রহের আকারের একটি পাথুরে কেন্দ্র রয়েছে। এই দুটি গ্রহে চুম্বক ক্ষেত্রের অভাবের কারণ এই স্তরগুলোর মিশ্রণহীনতা। যদি স্তরগুলো পৃথক না হত, তাহলে সংমিশ্রণ প্রক্রিয়া চালু থাকত এবং ডাইপোল চুম্বক ক্ষেত্র তৈরি হত।
মিলিতজারের এই ধারণা যাচাই করতে ভবিষ্যতে ল্যাবরেটরি পরীক্ষা এবং ইউরেনাসে একটি মহাকাশ অভিযান পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে। তার মতে, এই গবেষণা সৌরজগতের বরফীয় গ্রহগুলোর অভ্যন্তর গঠন সম্পর্কে আমাদের ধারণা আরও উন্নত করতে পারে এবং গ্রহের গঠন এবং তাদের চুম্বক ক্ষেত্র সম্পর্কে নতুন ধারণা দিতে পারে।
ইউরেনাস এবং নেপচুনের এই চুম্বক রহস্যের সমাধান আমাদের সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহগুলো সম্পর্কেও নতুন তথ্য ও ধারণা প্রদান করতে পারে। বিজ্ঞানীরা এই দুই গ্রহের অভ্যন্তরীণ গঠন, পদার্থের পরিবর্তন এবং তাদের চুম্বক ক্ষেত্র নিয়ে আরও গবেষণা করার চেষ্টা করছেন। ভবিষ্যতে আরও উন্নত গবেষণা পদ্ধতি এবং মহাকাশ অভিযানের মাধ্যমে আমরা এই রহস্য সম্পর্কে আরও তথ্য পেতে পারি।
আরও পড়ুনঃ পৃথিবীতে জীবনের শুরু কীভাবে হলো? বিজ্ঞানীরা এবার নতুন এক তথ্য খোঁজে পেলো