এক সময়ের শীর্ষ কোম্পানি নকিয়া ফোনের উত্থান-পতনের গল্প

একটি ব্যবসা শুরু করা ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, তবে এটি সফল হলে তা সার্থক মনে হয়। আমরা এমন অনেক কোম্পানির গল্প দেখেছি, যারা শূন্য থেকে শুরু করে আজ তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আবার এমন অনেক কোম্পানি আছে, যারা শুরুতে সফল হয়েছিল, কিন্তু শীর্ষে উঠতে পারেনি এবং ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে। তবে যেটি সত্যিই আমাদের মনে বেশি আগ্রহ জাগিয়েছে, তা হলো এমন কোম্পানিগুলোর গল্প, যারা একসময় শীর্ষে ছিল কিন্তু পরে হঠাৎ করে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কোম্পানি একসময় মানুষের মনে গেঁথে গিয়েছিল, কিন্তু এখন তারা শুধুই স্মৃতিচারণ। এমনই একটি কোম্পানি হলো নকিয়া।

আরও পড়ুনঃ অপারেটিং সিস্টেম কি? এটা কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? জানবো কি, কেন ও কিভাবে?

এক সময়ের মোবাইল দুনিয়ার শীর্ষ ব্র্যান্ড

১৯৯০ এবং ২০০০-এর দশকে নকিয়া ছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল কোম্পানি। এখনো পর্যন্ত ইতিহাসের সর্বাধিক বিক্রিত মোবাইল ফোন নকিয়ার তৈরি। আপনি যদি ৮০ বা ৯০-এর দশকে জন্মগ্রহণ করে থাকেন, তাহলে নকিয়া নিশ্চয়ই আপনার স্মৃতিতে মধুর একটি জায়গা দখল করে আছে। প্রথম যে মোবাইল ফোনটি আপনি ব্যবহার করেছিলেন, সেটি হয়তো নকিয়ার ছিল। সেসব ফোনে তেমন বিশেষ কিছু ছিল না। কল করা, টেক্সট পাঠানো এবং অবশ্যই সেই বিখ্যাত স্নেক গেম খেলা যেত।

নকিয়ার শুরুর গল্প

নকিয়ার যাত্রা শুরু হয় ১৮৬৫ সালে। তখন অবশ্য তারা মোবাইল ফোন বানাত না; তারা কাঠের পাল্প এবং কাগজ তৈরি করত। ১৮৬৫ সালে ফিনল্যান্ডের সুইডিশ বংশোদ্ভূত প্রকৌশলী ফ্রেডরিক ইডেস্টাম তামপেরে নামক একটি শহরে একটি কাঠের পাল্প কারখানা স্থাপন করেন। পরবর্তীতে ১৮৬৮ সালে আরও ভালো জলবিদ্যুৎ সুবিধার জন্য তিনি নকিয়া নদীর তীরে আরেকটি কারখানা স্থাপন করেন। এখান থেকেই কোম্পানির নাম হয় “নকিয়া।”

পরবর্তী ১০০ বছর ধরে নকিয়া মূলত কাগজ তৈরি করত। তবে ধীরে ধীরে তারা রাবার, তার, টায়ার, টেলিভিশন এবং জুতা বানানোসহ বিভিন্ন খাতে প্রবেশ করে। নকিয়ার প্রকৃত রূপান্তর শুরু হয় ১৯৬০-এর দশকে। তখন শীতল যুদ্ধ শুরু হচ্ছিল, এবং ফিনল্যান্ড সরকার প্রতিরক্ষা বিষয়ে উদ্বেগ থেকে সামরিক রেডিও ও টেলিফোন প্রযুক্তির উন্নয়নে গবেষণা শুরু করে। এর নির্মাণ চুক্তি নকিয়া পায় এবং তারা সামরিক গ্রেডের রেডিও কমিউনিকেশন ডিভাইস তৈরি শুরু করে।

মোবাইল ফোনে নকিয়ার উত্থান

এক সময়ের শীর্ষ কোম্পানি নকিয়া ফোনের উত্থান-পতনের গল্প
ছবিঃ pexels/Gylfi Gylfason

১৯৮১ সালে নকিয়া মোবাইল ফোন বাজারে প্রবেশ করে। পরবর্তী এক দশকে তারা নানান ধরনের পণ্য তৈরি করলেও ১৯৯২ সালে নতুন সিইও জর্মা অলিলা দায়িত্ব নেওয়ার পর কোম্পানিটি শুধুমাত্র মোবাইল ফোনে মনোযোগ দেওয়া শুরু করে।

১৯৯২ সালে নকিয়া প্রথম ডিজিটাল জিএসএম ফোন, নকিয়া ১০১১ বাজারে লঞ্চ করে। এরপর ১৯৯৪ সালে নকিয়া ২১১০ বাজারে আনে, যা ছিল প্রথম ফোন যাতে বিখ্যাত নকিয়া রিংটোন শোনা যেত। এটি একটি বিশাল সাফল্য ছিল। ১৯৯৬ সালে নকিয়া ৯০০০ কমিউনিকেটর নামে একটি ডিভাইস বাজারে আনে, যা আধুনিক স্মার্টফোনের মতোই ছিল। এতে ইমেল, ওয়েব ব্রাউজিং, ওয়ার্ড প্রসেসিং এবং স্প্রেডশিট তৈরির সুবিধা ছিল। যদিও এটি সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে ছিল এবং অধিকাংশ মানুষের জন্য এটি গ্রহণযোগ্য ছিল না।

১৯৯৮ সালে নকিয়া মোটোরোলাকে টপকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় মোবাইল ফোন নির্মাতা হয়ে ওঠে। ২০০৩ সালে নকিয়া ১১০০ মডেলটি বাজারে আনে, যা এখনো পর্যন্ত সর্বাধিক বিক্রিত মোবাইল ফোন।

নকিয়ার পতনের কারণ

২০০৭ সালে অ্যাপল তাদের প্রথম আইফোন বাজারে নিয়ে আসে, যা মোবাইল প্রযুক্তি শিল্পে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন আনে। আইফোনের শুরুটা ধীরগতির হলেও সময়ের সাথে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। উন্নত সফটওয়্যার, ব্যবহারকারীদের জন্য সহজতর অভিজ্ঞতা এবং আধুনিক ডিজাইনের মাধ্যমে এটি দ্রুত বাজারে আধিপত্য বিস্তার করে। বিপরীতে, নকিয়া তাদের পুরোনো সিম্বিয়ান অপারেটিং সিস্টেমে নির্ভর করে যা আইওএস এবং অ্যান্ড্রয়েডের মতো নতুন সিস্টেমের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে। কোম্পানির অভ্যন্তরীণ বিভক্তি, নেতৃত্বের অভাব এবং সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে না পারার ফলে তাদের নতুন সফটওয়্যার উন্নয়ন প্রক্রিয়া মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে, নকিয়া ক্রমশ বাজার থেকে পিছিয়ে পড়ে এবং মোবাইল ফোন শিল্পে তাদের অবস্থান হারায়।

মাইক্রোসফটের সাথে চুক্তি ও পতন

২০১১ সালে নকিয়া সিম্বিয়ান থেকে সরে এসে মাইক্রোসফটের উইন্ডোজ ফোন অপারেটিং সিস্টেম গ্রহণ করে। পরে ২০১৪ সালে মাইক্রোসফট নকিয়ার মোবাইল বিভাগ কিনে নেয়। তবে এই চুক্তি সফল হয়নি এবং মাইক্রোসফট বিশাল ক্ষতির মুখে পড়ে। মাইক্রোসফটের ব্যর্থতার পেছনে অন্যতম কারণ ছিল অ্যান্ড্রয়েডের উত্থান এবং অ্যাপলের শক্তিশালী বাজার উপস্থিতি। উইন্ডোজ ফোনের অ্যাপ্লিকেশন ইকোসিস্টেমও অনেক পিছিয়ে ছিল, যা ব্যবহারকারীদের আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয়।

নকিয়া কি এখনও মোবাইল ফোন তৈরি করে?

নকিয়া এখন আর নিজেরা মোবাইল ফোন তৈরি করে না। যদিও “নকিয়া” ব্র্যান্ডের মোবাইল ফোন বাজারে পাওয়া যায়, সেগুলো নির্মাণ ও বাজারজাত করছে এইচএমডি গ্লোবাল নামে একটি কোম্পানি। এই কোম্পানি নকিয়ার সাবেক কর্মকর্তাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং নকিয়া ব্র্যান্ডের অধিকার নিয়ে কাজ করছে। নকিয়া বর্তমানে মূলত টেলিকম নেটওয়ার্ক এবং এর পরিকাঠামো নিয়ে কাজ করছে।

শিক্ষা

নকিয়ার পতন থেকে একটি বড় শিক্ষা হলো প্রতিযোগিতামূলক খাতে টিকে থাকতে হলে নতুনত্ব আনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একসময় শীর্ষে থাকা নকিয়া এই পরিবর্তনকে সময়মতো গ্রহণ করতে পারেনি, আর এর ফলেই তারা তাদের জায়গা হারিয়েছে। ব্যবসায় টিকে থাকতে হলে প্রযুক্তি এবং ব্যবহারকারীদের চাহিদার সাথে খাপ খাওয়ানো অপরিহার্য। নকিয়ার গল্প আমাদের এই শিক্ষা দেয় যে, সফলতা যদি ধরে রাখা না যায়, তবে তা অল্প সময়ের মধ্যেই হারিয়ে যেতে পারে।

ওয়ারলেস চার্জার প্রযুক্তি কিভাবে কাজ করে? জানুন কি কেন ও কিভাবে ?

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো