মানবদেহের নিউরনকে নিয়ন্ত্র করবে ওয়্যারলেস ডিভাইস

মানব মস্তিষ্কের অসাধারণ জটিলতা এবং সংবেদনশীলতার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে প্রতিটি নিউরন একে অপরের সাথে খুব সূক্ষ্ম এবং সংবেদনশীল উপায়ে সংযুক্ত থাকে। সেই সংযোগের মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক সংকেতগুলি প্রবাহিত হয়, যা আমাদের শারীরিক ও মানসিক ক্রিয়াকলাপকে নিয়ন্ত্রণ করে। এই নিউরনগুলোর কাজের অস্বাভাবিকতা বা ক্ষতিগ্রস্থতা বিভিন্ন স্নায়বিক রোগের কারণ হতে পারে। এই সমস্যা সমাধানে গবেষকরা এখন একটি নতুন প্রযুক্তি আবিষ্কার করেছেন, যা মানবদেহের প্রতিটি কোষের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম। নতুন আবিষ্কৃত এই প্রযুক্তির নাম ‘ওয়্যারলেস ডিভাইস’।

এটি একটি মাইক্রোস্কোপিক ডিভাইস, যা নিউরন বা স্নায়ুর চারপাশে মসৃণভাবে জড়িয়ে থাকতে পারে এবং এটি ব্যাটারিহীন, হালকা, নরম পলিমার দিয়ে তৈরি। এটি নিউরনের বিভিন্ন অংশ যেমন, এক্সন (axon) এবং ডেনড্রাইট (dendrite) এর চারপাশে নষ্ট না করেই জড়িয়ে যেতে পারে। এটি বিজ্ঞানীদের মস্তিষ্কের কোষের অন্তর্গত বিভিন্ন অংশ সম্পর্কে আরও গভীরভাবে বোঝার সুযোগ দেবে এবং স্নায়ুবৈকল্য সম্পর্কিত বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সহায়ক হবে।

আরও পড়ুনঃ বায়োইলেক্ট্রনিক জেল যেন বাস্তব ভেনম মুভির সিম্বায়োট

এই ডিভাইসটি নিউরনের বৈদ্যুতিক এবং বিপাকীয় ক্রিয়াকলাপ পরিমাপ করতে এবং তা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হবে। এরকম সূক্ষ্ম এবং সংবেদনশীল ওয়্যারলেস ডিভাইস মস্তিষ্কের অন্তর্গত কোষগুলোর ক্ষুদ্রতম অংশেও প্রবেশ করে তাদের কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। ডিভাইসটি খুবই ক্ষুদ্র এবং নরম হওয়ায় এটি কোনও ক্ষতি ছাড়াই নিউরনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারে। ভবিষ্যতে, এই ধরনের ওয়্যারলেস ডিভাইস হাজার হাজার সংখ্যায় মস্তিষ্কের মধ্যে প্রবেশ করানো যেতে পারে এবং তা আলো দিয়ে চালিত করা যেতে পারে।

গবেষকরা এই ডিভাইসটি তৈরি করতে একটি নরম পলিমার নামক ‘আজোবেঞ্জিন’ ব্যবহার করেছেন, যা আলো পড়লে রোল বা ঘূর্ণিত হতে পারে। এর ফলে এটি নিউরনের চারপাশে খুব সহজে জড়াতে সক্ষম হয়। এই রোলিংয়ের দিক এবং ব্যাসার্ধ আলোর তীব্রতা এবং মেরুকরণের মাধ্যমে নির্ধারণ করা যায়। ডিভাইসটি মাইক্রোস্কোপিক টিউব তৈরি করতে সক্ষম, যার ব্যাস এক মাইক্রোমিটারেরও কম হতে পারে। এর ফলে এটি অত্যন্ত বাঁকানো অক্ষ এবং ডেনড্রাইটের চারপাশে মসৃণভাবে জড়াতে পারে।

MIT-এর গবেষকরা এই ডিভাইসটি তৈরি করতে একাধিক পরীক্ষামূলক পদ্ধতি ব্যবহার করেছেন যাতে তারা সহজ এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটি তৈরি করতে পারেন। তাঁরা প্রথমে আজোবেঞ্জিনের একটি বিন্দু জলের দ্রবণীয় পদার্থের উপর প্রয়োগ করেন এবং তারপর এটি একটি স্ট্যাম্প দিয়ে চেপে হাজার হাজার ক্ষুদ্র ডিভাইসের গঠন তৈরি করেন। এরপর, তাঁরা বেকিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রাবকগুলি শুকিয়ে নেন এবং অতিরিক্ত পদার্থটি খোঁচা দিয়ে পরিষ্কার করেন। পরিশেষে, তাঁরা জলের মধ্যে এই বিনিময়যোগ্য স্তরটি দ্রবীভূত করেন এবং এতে অনেক ক্ষুদ্র ডিভাইস তৈরি হয়।

এই ক্ষুদ্র ডিভাইসগুলো নষ্ট না হওয়া পর্যন্ত আলোর মাধ্যমে চালিত করতে পারে এবং একবার রোলিং হয়ে গেলে তাদের আকৃতি কয়েক দিন পর্যন্ত বজায় রাখতে সক্ষম হয়। গবেষকরা দেখতে পান, এই ডিভাইসগুলি র‍্যাট (ইঁদুর) নিউরনের উপর পরীক্ষা করে দেখতে পেয়েছেন যে এটি নিউরনের অত্যন্ত বাঁকানো অক্ষ এবং ডেনড্রাইটগুলোর চারপাশেও জড়াতে সক্ষম হয়েছে এবং এতে কোনও ক্ষতি হয়নি।

এই ডিভাইসটির সাহায্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্ভাবনা হল ক্ষতিগ্রস্থ স্নায়ুর পুনরুদ্ধার। বিশেষ করে মাইলিন নামক পদার্থ, যা অক্ষগুলোর চারপাশে জড়িয়ে থাকে এবং বৈদ্যুতিক সংকেতগুলোকে দ্রুত চলাচল করতে সাহায্য করে। মাইলিনের অভাবের কারণে মস্তিষ্কের নিউরনগুলোর বৈদ্যুতিক কার্যকলাপ ব্যাহত হয় এবং এটি বিভিন্ন স্নায়ুবৈকল্য রোগ যেমন ‘মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস’ এর জন্য দায়ী। এই ওয়্যারলেস ডিভাইসটি সিন্থেটিক মাইলিন হিসেবে কাজ করতে পারে এবং নিউরনগুলোর পুনরুদ্ধারে সাহায্য করতে পারে।

এছাড়াও, এই ডিভাইসের সাহায্যে অপ্টোইলেক্ট্রিক্যাল উপাদান সংযুক্ত করা যায় যা কোষগুলোকে উদ্দীপ্ত করতে পারে। তদুপরি, এই ডিভাইসে আণবিক পাতলা উপাদান বসানো যেতে পারে, যা এখনও মাইক্রোটিউব গঠন করতে সক্ষম এবং এটি ভাঙ্গে না। এই সুবিধার কারণে ডিভাইসে সেন্সর এবং সার্কিট সংযুক্ত করা সম্ভব, যা মস্তিষ্কের রোগ নিরাময়ে অত্যন্ত কার্যকরী হতে পারে।

মানব মস্তিষ্কের কোষ ভার্চুয়াল প্রজাপতিকে পরিচালনা করছে

এই গবেষণায় আরও অনেক সম্ভাবনার দরজা খুলেছে। গবেষকরা আশা করছেন যে ভবিষ্যতে এই ডিভাইসগুলির পৃষ্ঠে বিভিন্ন ধরনের অণু সংযোজন করে বিশেষ কোষের নির্দিষ্ট অংশকে লক্ষ্য করা যাবে। এছাড়াও মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট স্থানগুলিকে উদ্দীপ্ত করার মাধ্যমে স্নায়ুবৈকল্য বা মানসিক রোগ নিরাময়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আলোর মাধ্যমে এই ডিভাইসগুলিকে চালিত করার কারণে অল্প শক্তি ব্যবহার করে কোষগুলিকে উদ্দীপ্ত করা সম্ভব, যা মস্তিষ্কের সূক্ষ্ম অংশগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ দেয়।

এই ডিভাইসগুলো এমন একটি যুগান্তকারী প্রযুক্তির সূচনা করেছে যা ভবিষ্যতে স্নায়ুবিজ্ঞানের গবেষণায় এক নতুন দিগন্তের সূচনা করবে। নিউরনের সাথে একটি কৃত্রিম ডিভাইসের এমন সহাবস্থান এর আগে কখনও সম্ভব হয়নি। এ ধরনের মাইক্রোস্কোপিক ডিভাইসগুলির ব্যবহার মস্তিষ্কের কোষগুলোর সাথে আরও ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার সুযোগ দেবে এবং স্নায়ুবৈকল্য নিরাময়ে এক নতুন যুগের সূচনা করতে সহায়ক হবে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো