যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আপিল আদালত সম্প্রতি একটি আইন বহাল রেখেছে, যার ফলে চীনা প্রতিষ্ঠান বাইটড্যান্সকে টিকটকের মালিকানা ছেড়ে দিতে হবে অথবা যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হবে। জাতীয় নিরাপত্তার উদ্বেগকে সামনে রেখে আদালত এই রায় প্রদান করে, যা আগামী মাসে কার্যকর হওয়ার কথা। এই রায় চ্যালেঞ্জ করে টিকটক যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করার পরিকল্পনা করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইন প্রণেতাদের অভিযোগ, চীনা সরকার টিকটক ব্যবহার করে যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের গোপনীয় তথ্য সংগ্রহ এবং কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর আঘাত হানতে পারে। এই আইন কার্যকর হলে, বাইটড্যান্স যদি জানুয়ারি ১৯, ২০২৫ সালের মধ্যে টিকটকের মালিকানা ছেড়ে না দেয়, তবে অ্যাপ স্টোর এবং ইন্টারনেট হোস্টিং পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে টিকটকের সাপোর্ট বন্ধ করতে হবে। এর ফলে, কার্যত টিকটক নিষিদ্ধ হয়ে যাবে।
আরও পড়ুনঃ ইলন মাস্ক এবং ওপেনএআই এর মধ্যে দ্বন্দ্ব
জাতীয় নিরাপত্তা এবং আইনের যৌক্তিকতা
মার্কিন অ্যাটর্নি জেনারেল মেরিক গারল্যান্ড আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন, “এই সিদ্ধান্ত চীনা সরকারের হাত থেকে টিকটককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ বন্ধ করার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।” তিনি আরও যোগ করেন, এই আইন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় অপরিহার্য। আদালতের মতে, এই আইন নির্দিষ্টভাবে একটি বিদেশি শত্রুর হাত থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রতিরোধের জন্য তৈরি করা হয়েছে এবং জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত।
আইনটি পাস হওয়ার পেছনে উভয় রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিল। কংগ্রেসের সদস্যরা চীনা সরকারের সাথে টিকটকের সম্ভাব্য সংযোগ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। রিপাবলিকান কংগ্রেসম্যান ট্রয় বাল্ডারসন টিকটককে “একটি নজরদারি সরঞ্জাম” বলে আখ্যায়িত করেছেন যা মার্কিন নাগরিকদের ব্যক্তিগত তথ্য চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যবহার হতে পারে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও এই বিষয়ে কড়া অবস্থান নিয়ে আইনটিতে স্বাক্ষর করেন।
টিকটকের যুক্তি এবং সুপ্রিম কোর্টে আবেদন
টিকটকের দাবি, এই আইন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের প্রথম সংশোধনীতে উল্লেখিত মত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের লঙ্ঘন। প্রতিষ্ঠানটি বলেছে, “টিকটক নিষিদ্ধ হলে ১৭০ মিলিয়নেরও বেশি আমেরিকান ব্যবহারকারীর মত প্রকাশ এবং যোগাযোগের স্বাধীনতা ব্যাহত হবে।”
এছাড়াও, টিকটকের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, এই নিষেধাজ্ঞার ভিত্তি ত্রুটিপূর্ণ তথ্যের ওপর নির্ভরশীল এবং এটি শুধুমাত্র একটি কাল্পনিক বিপদের ধারণা সৃষ্টি করে। তাই তারা আদালতের এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করবে। তবে, সুপ্রিম কোর্ট এই মামলা গ্রহণ করবে কি না, তা এখনও নিশ্চিত নয়।
সমালোচনা এবং মানবাধিকারের প্রশ্ন
আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়নের (ACLU) ডেপুটি ডিরেক্টর প্যাট্রিক টুমি এই রায়ের কঠোর সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, “এই রায় একটি বিপজ্জনক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে, যা সরকারের হাতে অনলাইন মত প্রকাশ নিয়ন্ত্রণের অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করে।” টুমি আরও বলেন, “একটি পুরো যোগাযোগ প্ল্যাটফর্ম বন্ধ করার জন্য সরকারকে অত্যন্ত গুরুতর এবং তাৎক্ষণিক ক্ষতির প্রমাণ দিতে হবে, যা এই ক্ষেত্রে অনুপস্থিত।”
টিকটক বিষয়ক এই বিতর্কের মধ্যেই, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের অবস্থান এক ধরণের ধোঁয়াশাপূর্ণ। তিনি তার প্রথম প্রশাসনের সময় টিকটক নিষিদ্ধ করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন। তবে, টিকটকের বিনিয়োগকারী এবং রিপাবলিকান সমর্থক জেফ ইয়াসের সাথে সাক্ষাতের পর তার বক্তব্য কিছুটা পরিবর্তিত হয়েছে। ইয়াসের কোম্পানি বাইটড্যান্সের একটি বড় অংশের মালিক, যা ট্রাম্পের ভবিষ্যৎ অবস্থানের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
আরও পড়ুনঃ ‘ডেটিং ও কমপ্যানিওনশিপ’ এর উপর গুগল নতুন বিজ্ঞাপন পলিসি ঘোষণা করেছে
টিকটক নিষিদ্ধ হলে এর প্রভাব কি হবে?
১. ব্যবহারকারীদের উপর প্রভাব: টিকটক নিষিদ্ধ হলে যুক্তরাষ্ট্রে এর কোটি কোটি ব্যবহারকারী কনটেন্ট তৈরি এবং শেয়ারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হারাবে। এছাড়াও, তরুণ প্রজন্মের জন্য টিকটক একটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে, যা বন্ধ হলে তাদের ডিজিটাল যোগাযোগে ব্যাঘাত ঘটতে পারে।
২. প্রযুক্তি খাতে প্রভাব: এই রায় অন্যান্য প্রযুক্তি প্ল্যাটফর্মগুলোর উপর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ বাড়ানোর সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। গুগল এবং অ্যাপলের মতো বড় কোম্পানিগুলোর অ্যাপ স্টোর নীতি এবং ডেটা সুরক্ষার বিষয়টি নতুন করে আলোচনায় আসতে পারে।
৩. চীন-মার্কিন সম্পর্ক: টিকটক ইস্যু চীন-মার্কিন সম্পর্কের মধ্যে নতুন উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে, যা উভয় দেশের প্রযুক্তি ও বাণিজ্য খাতে দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষ করে, চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে প্রবেশে আরও কঠোর বাধার মুখোমুখি হতে পারে।
৪. ব্যক্তিগত ডেটার সুরক্ষা: এই বিতর্ক যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের ডেটা সুরক্ষার বিষয়েও নতুন প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। যদিও টিকটক দাবি করেছে যে তারা মার্কিন ব্যবহারকারীদের ডেটা নিরাপদ রাখতে কাজ করছে, তবুও সরকারের উদ্বেগ সম্পূর্ণভাবে দূর হয়নি।
৫. মত প্রকাশের স্বাধীনতা: এই ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্রে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও জাতীয় নিরাপত্তার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করার প্রশ্নকে আরও তীব্র করেছে। অনেকেই মনে করেন, টিকটকের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ একটি বড় ধরনের সেন্সরশিপের উদাহরণ হতে পারে।
৬. ব্যবসায়িক প্রভাব: টিকটকের নিষেধাজ্ঞা শুধু প্ল্যাটফর্মটির উপর নয়, বরং টিকটক সংশ্লিষ্ট নির্মাতা এবং ব্যবসায়িক অংশীদারদের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে মার্কেটিং এবং ব্র্যান্ড প্রচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হারিয়ে যাবে।
এখন দেখার বিষয়, টিকটক সুপ্রিম কোর্টে এ ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক ফলাফল পায় কিনা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আইন কীভাবে এটি কার্যকর করতে সক্ষম হয়। একইসাথে, জাতীয় নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করা কতটা সম্ভব তা নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত থাকবে।
হারমনি ওএস নেক্সট- কি সত্যিই অ্যান্ড্রয়েড এর একটি প্রকৃত বিকল্প হতে পারে?