স্টার ওয়ার্স মুভির “ট্র্যাক্টর বিম” এখন বাস্তবে

আমরা যারা ‘স্টার ওয়ার্স’ মুভির ভক্ত, তারা প্রায়ই কল্পনা করি কিভাবে ট্র্যাক্টর বিম ব্যবহার করে বিশাল যান্ত্রিক বস্তু ধরা হয়। অবাক করা বিষয় হলো, এমআইটি গবেষকরা ঠিক এরকমই এক ধরণের ট্র্যাক্টর বিম আবিষ্কার করেছেন। তারা একটি চিপ-ভিত্তিক ক্ষুদ্র ট্র্যাক্টর বিম তৈরি করেছেন যা ছোট ছোট কণিকা বা কোষ সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। এই প্রযুক্তিটি ভবিষ্যতে বায়োলজিস্ট এবং চিকিৎসকগণকে ডিএনএ পরীক্ষা, কোষের শ্রেণীবিভাগ এবং রোগের প্রক্রিয়া তদন্ত করতে সাহায্য করতে পারে। এই নতুন প্রযুক্তি এমন একটি খোঁজ যা জীববিজ্ঞানীদের গবেষণায় সহজতা নিয়ে আসবে।

এই ট্র্যাক্টর বিমটি দেখতে ছোট হলেও এর কার্যক্ষমতা বিশাল। এটি একটি সিলিকন-ফোটনিকস চিপ ব্যবহার করে আলোর বিম ছেড়ে দেয়, যা চিপের পৃষ্ঠ থেকে কয়েক মিলিমিটার দূরে থাকা কণিকাগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এই আলোর বিম কাচের কভার স্লিপের মধ্য দিয়েও প্রবেশ করতে পারে, যা জীববিজ্ঞানে ব্যবহৃত নমুনাগুলোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এতে কোষগুলো তাদের জীবাণুমুক্ত পরিবেশেই থাকে এবং কোনো দূষণের ঝুঁকি থাকে না।

আধুনিক পরীক্ষাগারে প্রচলিত অপটিকাল টুইজার ব্যবহার করা হয় কণিকা সংগ্রহ ও নিয়ন্ত্রণ করতে। তবে এই প্রযুক্তিগুলো সাধারণত বড় আকারের মাইক্রোস্কোপ এবং বিভিন্ন ডিভাইসের উপর নির্ভরশীল। এমআইটির এই নতুন চিপ-ভিত্তিক ট্র্যাক্টর বিম এ সমস্যা দূর করতে পারে, কারণ এটি ছোট এবং সহজে বহনযোগ্য।

আরও পড়ুনঃ বায়োইলেক্ট্রনিক জেল যেন বাস্তব ভেনম মুভির সিম্বায়োট

প্রচলিত অপটিকাল টুইজারের সমস্যা

আমরা যদি প্রচলিত অপটিকাল টুইজারের কথা বলি, তাহলে দেখতে পাবো, এসব ডিভাইস সাধারণত কণিকাগুলোকেই চিপের পৃষ্ঠে আনতে প্রয়োজন হয়, যা জীবাণুমুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা বেশ কঠিন করে তোলে। এতে কোষগুলো স্ট্রেসড হয়ে যায় এবং গবেষণা প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয়। এমনকি প্রতিটি নতুন পরীক্ষার জন্য নতুন চিপ ব্যবহার করতে হয়, যা ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ।

কিন্তু এমআইটির গবেষকরা এই সমস্যার সমাধান করেছেন। তারা একটি নতুন সিলিকন ফোটনিকস চিপ তৈরি করেছেন যা চিপের পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ মিলিমিটার ওপরে আলোর বিম তৈরি করতে পারে। এটি কাঁচের কভার স্লিপের মধ্যে থাকা জীবাণুমুক্ত কোষগুলোকেও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম, ফলে চিপ দূষণ থেকে রক্ষা পায় এবং একই চিপ একাধিকবার ব্যবহার করা সম্ভব হয়।

ইন্টিগ্রেটেড অপটিকাল ফেজড অ্যারের ব্যবহার

এই চিপটি তৈরি করতে গবেষকরা ব্যবহার করেছেন ‘ইন্টিগ্রেটেড অপটিকাল ফেজড অ্যারে’ নামক প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে চিপের মধ্যে মাইক্রোস্কেল অ্যান্টেনার একটি সিরিজ তৈরি করা হয় যা সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রস্তুত করা হয়। প্রতিটি অ্যান্টেনার অপটিকাল সংকেত ইলেকট্রনিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করে গবেষকরা আলোর বিমের আকৃতি এবং গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

এমআইটি দলটি দেখিয়েছে যে সঠিক ফেজ প্যাটার্ন তৈরি করার মাধ্যমে তারা একটি শক্তিশালী আলোর বিম তৈরি করতে পারে, যা চিপের পৃষ্ঠ থেকে কয়েক মিলিমিটার দূর থেকে কণিকাগুলোকে ধরতে সক্ষম। এটি একটি নতুন মাইলফলক, যা অপটিকাল টুইজার প্রযুক্তিকে আরও কার্যকর এবং বহুল ব্যবহারের উপযোগী করে তুলেছে।

দীর্ঘ দূরত্বে কোষ নিয়ন্ত্রণ

এই প্রযুক্তির সাহায্যে গবেষকরা প্রথমবারের মতো সিলিকন ফোটনিকস-ভিত্তিক অপটিকাল টুইজার তৈরি করেছেন, যা মিলিমিটার পরিসরে কণিকা নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম। প্রচলিত অপটিকাল টুইজারের তুলনায় এটি কয়েকশ গুণ বেশি কার্যকর। আলোর সংকেতের তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তন করে গবেষকরা আলোর বিমের ফোকাল পয়েন্ট নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন এবং মাইক্রোস্কেল সঠিকতা নিয়ে কোষগুলোকে স্থানান্তর করতে পারেন।

এই নতুন চিপটির কার্যকারিতা পরীক্ষা করতে গবেষকরা প্রথমে ছোট পলিস্টাইরিন কণিকাগুলো ধরতে চেষ্টা করেন। এতে সফল হওয়ার পর তারা ক্যান্সার কোষ নিয়ন্ত্রণের পরীক্ষা করেন, যা সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়। এতে প্রমাণিত হয় যে এই চিপটি শুধু ক্ষুদ্র কণিকাই নয় বরং জীবিত কোষও নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম।

এই প্রযুক্তির সাহায্যে জীববিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন দ্বার উন্মোচিত হচ্ছে। গবেষকরা আশা করছেন, ভবিষ্যতে তারা আলোর বিমের ফোকাল হাইট নিয়ন্ত্রণযোগ্য করতে সক্ষম হবেন, যা আরও জটিল জীববিজ্ঞানী গবেষণায় ব্যবহৃত হবে। এই প্রযুক্তি বায়োলজিস্টদের জন্য অনেক সহজ এবং সুবিধাজনক হবে কারণ তারা বড় মাইক্রোস্কোপ ছাড়াই কোষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন।

এমআইটির গবেষক দলের প্রধান গবেষক জলেনা নটরোস বলেছেন, “এই গবেষণাটি চিপ-ভিত্তিক অপটিকাল টুইজার প্রযুক্তিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে, কারণ আমরা আগের তুলনায় আরও বড় দূরত্বে কোষ নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছি। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির বিভিন্ন ব্যবহারের বিষয়টি চিন্তা করতেই বেশ উত্তেজনা অনুভব করছি।”

এই গবেষণায় নটরোসের সঙ্গে কাজ করেছেন প্রধান লেখক এবং ইইসিএস গ্রাজুয়েট ছাত্র তাল স্নেহ, সাব্রিনা কোরসেটি, মিলিকা নটরোস, এবং জোয়েল ভোল্ডম্যান। এই গবেষণার ফলাফল সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশন্সে প্রকাশিত হয়েছে।

মানব মস্তিষ্কের কোষ ভার্চুয়াল প্রজাপতিকে পরিচালনা করছে

বায়োফিজিক্সে এই নতুন প্রযুক্তি বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সমাধান করতে সক্ষম হবে। যেমন, কোষের গতিবিধি ট্র্যাক করা, সঠিক ট্রাপ শক্তি নির্ধারণ করা এবং কার্যকর ডেটা পোস্টপ্রসেসিং এর মাধ্যমে গবেষণাকে আরও সহজ করবে।

গবেষক দলটি ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির ফোকাল হাইট নিয়ন্ত্রণযোগ্য করতে এবং আরও জটিল বায়োলজিক্যাল সিস্টেমে এর প্রয়োগ করতে আগ্রহী। তারা আশা করছেন একাধিক ট্রাপ সাইট তৈরি করে একাধিক কণিকাকে একসঙ্গে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে, যা জীববিজ্ঞানের গবেষণায় নতুন দ্বার উন্মোচন করবে।

এমআইটির এই নতুন আবিষ্কার আমাদেরকে বুঝিয়ে দিয়েছে যে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন কোন সীমায় থেমে থাকে না। যা একসময় কেবল কল্পনা ছিল, আজ তা বাস্তবে রূপ নিয়েছে। এই ট্র্যাক্টর বিম প্রযুক্তি হয়তো একদিন বায়োলজিস্ট এবং চিকিৎসকদের জন্য একটি অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে।

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো