বর্তমান প্রযুক্তিগত উন্নতির যুগে, নিত্য নতুন উদ্ভাবন আমাদের জীবনকে সহজতর এবং কার্যকর করে তুলছে। এর মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হলো কিরিগামি ডিজাইন এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহারের মাধ্যমে বস্তু পরিচালনা করার নতুন পদ্ধতি। এই পদ্ধতি কোনো বস্তুকে শারীরিকভাবে ধরার প্রয়োজন ছাড়াই পরিচালনা করতে সক্ষম, যা বিশেষত ভঙ্গুর বস্তু, তরল, বা জেলজাতীয় পদার্থ উত্তোলন ও স্থানান্তরের ক্ষেত্রে অত্যন্ত কার্যকর। এ প্রযুক্তি সংকীর্ণ বা সীমাবদ্ধ স্থানে কার্যকরভাবে কাজ করতে সক্ষম, যেখানে প্রচলিত যন্ত্রপাতি যেমন রোবোটিক বাহু কাজ করতে পারে না।
উদ্ভাবনী এ ডিভাইসটি তৈরি করেছেন উত্তর ক্যারোলিনা স্টেট ইউনিভার্সিটির গবেষকরা। এটি কিরিগামি কৌশল এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ডের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ। গবেষক জি ইয়িন বলেন, “আমরা এখানে দুটি চ্যালেঞ্জ সমাধানের চেষ্টা করেছি। প্রথমত, এমন বস্তুকে কীভাবে স্থানান্তর করা যায় যা গ্রিপার দিয়ে ধরা যায় না, যেমন ভঙ্গুর বস্তু বা সংকীর্ণ স্থানের বস্তু। দ্বিতীয়ত, এমন বস্তুকে কীভাবে চৌম্বকক্ষেত্র ব্যবহার করে উত্তোলন করা যায় যা নিজে চৌম্বক নয়।”
আরও পড়ুনঃ ট্যাটুর মাধ্যমে মস্তিষ্কের তরঙ্গ রিয়েল টাইম মনিটরিং
এই সমস্যার সমাধানে, গবেষকরা একটি “মেটাশিট” তৈরি করেছেন যা একটি ইলাস্টিক পলিমার দিয়ে তৈরি এবং এতে ছোট ছোট চৌম্বকীয় মাইক্রোপার্টিকেল এমবেড করা হয়েছে। এই শিটের উপর কিরিগামি পদ্ধতিতে নকশা কাটা হয়েছে এবং এটি একটি শক্ত ফ্রেমের সাথে যুক্ত। ম্যাগনেটিক ফিল্ড ব্যবহার করে, মেটাশিটের নির্দিষ্ট অংশগুলোকে উপরে উঠানো বা নিচে নামানো সম্ভব। এই মেটাশিটের পৃষ্ঠকে ঢেউয়ের মতো নাড়ানোর মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের বস্তু স্থানান্তর করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, তরল ফোঁটা, গ্লাসের টুকরো, বা নাজুক কোনো বস্তু সহজেই সরানো সম্ভব।
গবেষক জি ইয়িন বলেন, “ম্যাগনেটিক ফিল্ডের দিক নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আপনি মেটাশিটের পৃষ্ঠকে ঢেউয়ের মতো নাড়াতে পারেন। ফিল্ডের শক্তি বাড়ানো বা কমানোর মাধ্যমে ঢেউয়ের উচ্চতা নির্ধারণ করা যায়।” এই পদ্ধতির মাধ্যমে বস্তু স্থানান্তর করার প্রক্রিয়া অত্যন্ত মসৃণ এবং কার্যকর। জো ট্রেসি, যিনি এই গবেষণার সহ-লেখক এবং এনসিসি স্টেটের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক, বলেন, “মেটাশিটের পৃষ্ঠের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করে আমরা বিভিন্ন ধরনের বস্তু পরিচালনা করতে পারি।”
মেটাশিটের নমনীয়তা এবং স্থায়িত্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে কিরিগামি নকশা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিরিগামি হলো একটি বিশেষ পদ্ধতি যেখানে কাগজ বা অন্যান্য পদার্থ কেটে ভাঁজ করা হয়। এই পদ্ধতি মেটাশিটের নমনীয়তা বাড়ায় এবং একই সঙ্গে এর মূল কাঠামোগত শক্তি অক্ষুণ্ণ রাখে। গবেষক ইয়িন্দিং চি, যিনি এই গবেষণার প্রথম লেখক এবং বর্তমানে পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পোস্টডক্টরাল গবেষক, বলেন, “কিরিগামি নকশা ব্যবহার করে আমরা উপাদানের বিকৃতি বাড়াতে পারি এবং এর যান্ত্রিক শক্তি বজায় রাখতে পারি।” তিনি আরও বলেন, “এই মেটাশিট ম্যাগনেটিক ফিল্ডের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল এবং মাত্র দুই মিলিসেকেন্ডের মধ্যে সাড়া দিতে পারে।”
গবেষকরা উল্লেখ করেছেন যে কিরিগামি এবং ম্যাগনেটিক ফিল্ডের সম্মিলিত ব্যবহার বিভিন্ন ক্ষেত্রে অসীম সম্ভাবনা সৃষ্টি করতে পারে। যেমন:
- সফট রোবোটিক্স: নমনীয় রোবোটিক্স প্রযুক্তিতে মেটাশিট ব্যবহারের মাধ্যমে সংকীর্ণ স্থানেও জটিল কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব।
- উত্পাদন শিল্প: উত্পাদন প্রক্রিয়ায় নাজুক বা ছোট বস্তু স্থানান্তর করার জন্য এ প্রযুক্তি ব্যবহৃত হতে পারে।
- গেমিং এবং হ্যাপটিক টেকনোলজি: এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন ধরনের গেমিং ডিভাইস এবং স্পর্শ-সংক্রান্ত প্রযুক্তি তৈরি করা সম্ভব, যা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য সহায়ক হতে পারে।
- ক্ষুদ্র বস্তু স্থানান্তর: এই প্রযুক্তি আরও ছোট আকারে স্কেল করে ক্ষুদ্র বস্তু বা তরলের ক্ষুদ্র পরিমাণ পরিচালনা করার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
ম্যাগনেটিক ফিল্ড এবং কিরিগামি নকশার সমন্বয়ে তৈরি মেটাশিট প্রযুক্তি বর্তমান প্রযুক্তি দুনিয়ায় এক বিপ্লব সৃষ্টি করেছে। এটি শুধু বস্তু পরিচালনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেনি, বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে এর সম্ভাবনা নতুন নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে। ভবিষ্যতে, এ প্রযুক্তি উন্নততর রূপ নিয়ে আমাদের জীবনযাত্রা আরও সহজ করে তুলবে।
পোর্টেবল রক্তচাপ মাপার যন্ত্র যা অটোমেটিক রক্তচাপ পরিমাপ করবে