সম্প্রতি বিজ্ঞানীরা এক নতুন আবিষ্কার করেছেন, যা আলো এবং ছায়া সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে সম্পূর্ণ নতুনভাবে দেখতে বাধ্য করেছে। একটি লেজার রশ্মি এখন নিজের ছায়া ফেলতে সক্ষম, যা আগে কখনো ভাবা হয়নি। সাধারণত, আলো নিজে অন্য আলোতে চলে যেতে পারে এবং একে অপরের সাথে সংঘর্ষে আসে না। কিন্তু এই নতুন গবেষণার মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, এক বিশেষ শর্তে, লেজার রশ্মি এমন একটি অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে, যেখানে তা একটি ছায়া তৈরি করবে।
এই গবেষণাটি করেছেন ব্রুকহ্যাভেন ন্যাশনাল ল্যাবরেটরির গবেষক রাফায়েল আ. আবরাহাও এবং তার দল। তিনি বলেন, “আমরা এতদিন জানতাম যে, লেজার রশ্মির দ্বারা ছায়া তৈরি হওয়া সম্ভব নয়, কারণ আলো সাধারণত একে অপরের মধ্য দিয়ে চলে যায় এবং কোনো বাধা সৃষ্টি করে না। তবে, আমাদের এই নতুন পরীক্ষাটি এই ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করছে এবং আলো ও ছায়ার সম্পর্কে আমাদের ধারণাকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।”
আরও পড়ুনঃ চিকিৎসা ও পরিবেশ রক্ষায় ন্যানোমেকানিক্যাল রেজোনেটর প্রযুক্তি
গবেষণার মূল বিষয় হল, এক ধরনের অপটিক্যাল প্রক্রিয়া ব্যবহার করে তারা প্রমাণ করেছেন যে, লেজার রশ্মি এমন একটি শর্তে একটি নির্দিষ্ট উপাদানের মাধ্যমে অন্য একটি লেজার রশ্মির পথ আটকে দিয়ে ছায়া তৈরি করতে পারে। এই প্রক্রিয়াটি একটি নন-লিনিয়ার অপটিক্যাল প্রক্রিয়ার ফলস্বরূপ ঘটে, যা তখনই ঘটে যখন আলো একটি উপাদানের সাথে তার শক্তির উপর ভিত্তি করে প্রতিক্রিয়া করে।
গবেষকরা একটি রুবি স্ফটিক এবং বিশেষ লেজার তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করে দেখিয়েছেন যে, লেজার রশ্মি আলোর পথ ব্লক করতে সক্ষম এবং একটি দৃশ্যমান ছায়া তৈরি করতে পারে। এর জন্য তারা প্রথমে একটি সবুজ রঙের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন লেজার রশ্মি রুবি স্ফটিকের মধ্যে দিয়ে চালান এবং এর পাশ থেকে একটি নীল লেজার রশ্মি ব্যবহার করেন। যখন সবুজ রশ্মিটি রুবির মধ্যে প্রবাহিত হয়, তখন তা নীল লেজারের পথ ব্লক করে এবং একটি ছায়া সৃষ্টি করে।
এটা ছিল একটি বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা যা একটু অদ্ভুত ধারণা থেকে শুরু হয়েছিল। গবেষকরা ৩ডি সফটওয়্যার ব্যবহার করে পরীক্ষার স্কিম্যাটিক তৈরির সময় একটি লেজার রশ্মির ছায়া দেখছিলেন, যা তাদের কাছে খুবই হাস্যকর মনে হয়েছিল। কিন্তু পরে তারা বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে চিন্তা করতে শুরু করেন এবং সেই কথাবার্তা থেকেই এই চমকপ্রদ আবিষ্কারের জন্ম হয়।
গবেষণায় দেখানো হয়েছে যে, যখন সবুজ লেজার রশ্মি রুবি স্ফটিকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়, তখন এটি নীল লেজার রশ্মির শক্তিকে কমিয়ে দেয় এবং এইভাবে নীল লেজার রশ্মি কিছু অংশে অবরুদ্ধ হয়ে যায়, যা ঠিক একটি ছায়ার মতো কাজ করে। এই ছায়া ছিল পুরোপুরি দৃশ্যমান এবং তা স্বাভাবিক ছায়ার মতো পর্দায় ফুটে উঠছিল।
গবেষকরা এও বলেছেন যে, এই নতুন আবিষ্কারটি শুধু বিজ্ঞানী ও প্রযুক্তিবিদদের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং এটি বিভিন্ন প্রযুক্তি ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে পারে। যেমন, অপটিক্যাল সুইচিং ডিভাইস বা এমন প্রযুক্তি, যেখানে এক ধরনের আলো অন্য এক ধরনের আলো নিয়ন্ত্রণ করে, সেগুলোর উন্নতিতে এই আবিষ্কারটি সহায়ক হতে পারে। আরো গুরুত্বপূর্ণ যে, এই প্রযুক্তিটি এমন জায়গায় কাজে আসতে পারে যেখানে সঠিকভাবে আলোর প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন, যেমন উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন লেজার প্রযুক্তিতে।
গবেষকদের মতে, এটি লাইট-ম্যাটার ইন্টারঅ্যাকশনের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে এবং ভবিষ্যতে এর বিভিন্ন ব্যবহার হতে পারে। তারা বলেন, “এই নতুন ধারণাটি বিভিন্ন প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ব্যবহার হতে পারে, যেমন অপটিক্যাল সুইচিং বা এমন প্রযুক্তি যেখানে আলো অন্য আলো নিয়ন্ত্রণ করে।”
এই গবেষণাটি পরবর্তী সময়ে Optica জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে এবং এতে ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়েছে যে, লেজারের মাধ্যমে আলোর পথ কিভাবে ব্লক করা সম্ভব এবং এর প্রভাব কী হতে পারে। নতুন গবেষণা দেখিয়েছে যে, এক লেজারের রশ্মি আরেকটি লেজারের রশ্মিকে কিভাবে ব্লক করতে পারে, এবং তার মাধ্যমে একটি ছায়া তৈরি হয়। এর ফলে আলো ও ছায়ার তত্ত্বকে আরও গভীরভাবে বুঝতে সাহায্য করবে।
তবে, এই আবিষ্কারের পেছনে যে মৌলিক বিজ্ঞান কাজ করেছে, তা হচ্ছে নন-লিনিয়ার অপটিক্যাল প্রক্রিয়া, যা একটি বিশেষ উপাদান ব্যবহারের মাধ্যমে এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যেখানে আলো আরেকটি আলোর পথ বাধাগ্রস্ত করছে। এই নতুন ধরণের গবেষণার ফলে বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তির দিকে পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হতে পারে।
এছাড়া, গবেষকরা পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, লেজার রশ্মির শক্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ছায়ার কনট্রাস্টও বাড়ে এবং তারা পরিমাপ করেছেন যে, এই ছায়ার কনট্রাস্ট সূর্যের দিনের আলোতে গাছের ছায়ার মতোই প্রায় ২২% পরিমাণ ছিল।
এখন তারা পরবর্তী পরীক্ষাগুলো করার পরিকল্পনা করছেন, যেখানে অন্য উপাদান এবং লেজারের বিভিন্ন তরঙ্গদৈর্ঘ্য ব্যবহার করে এই একই ধরনের ফলাফল দেখা যাবে কিনা তা পরীক্ষা করা হবে।
এই গবেষণার মাধ্যমে, বিজ্ঞানীরা যেভাবে আলো ও ছায়ার মধ্যে সম্পর্ক ও আলোর গতিবিধি নিয়ে নতুন ধারণা তৈরি করেছেন, তাতে এক নতুন যুগের সূচনা হতে পারে, যেখানে লেজারের মাধ্যমে এক আলো আরেক আলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এবং একে অপরকে ব্লক করতে সক্ষম হয়।
এই আবিষ্কারের মাধ্যমে, এক ধরনের আলোর সাথে আরেক ধরনের আলো নিয়ন্ত্রণ করার নতুন দিক উন্মোচিত হয়েছে এবং এটি ভবিষ্যতে প্রযুক্তি খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে।