ব্লকচেইনে PoW (প্রুফ অফ ওয়ার্ক) এবং PoS (প্রুফ অফ স্টেক) কি? এই নিয়ে বিস্তারিত তথ্য

ব্লকচেইন প্রযুক্তি একটি বিকেন্দ্রীভূত সিস্টেম যেখানে ডাটা ব্লক আকারে সংরক্ষণ করা হয় এবং এটি ক্রিপ্টোগ্রাফি ব্যবহার করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। ব্লকচেইনে লেনদেন যাচাই করার এবং নতুন ব্লক যুক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট কনসেনসাস মেকানিজম ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে দুটি প্রধান কনসেনসাস মেকানিজম হলো প্রুফ অফ ওয়ার্ক (PoW) এবং প্রুফ অফ স্টেক (PoS)। এই নিবন্ধে আমরা এই দুটি পদ্ধতির সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব।

প্রুফ অফ ওয়ার্ক (PoW) কী?

প্রুফ অফ ওয়ার্ক (PoW) হলো ব্লকচেইনের প্রথম কনসেনসাস মেকানিজম, যা বিটকয়েনসহ বেশ কয়েকটি ক্রিপ্টোকারেন্সির জন্য ব্যবহৃত হয়। এটি মাইনিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে কাজ করে, যেখানে নেটওয়ার্কের অংশগ্রহণকারীরা জটিল গণিত সমস্যার সমাধান করে লেনদেন যাচাই এবং ব্লক তৈরি করে।

কীভাবে এটি কাজ করে?

প্রথমত- এটি প্রতিটি নতুন ব্লক তৈরি করার জন্য মাইনারদের একটি জটিল ক্রিপ্টোগ্রাফিক ধাঁধার সমাধান করতে হয়। এই ধাঁধাগুলো আসলে একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ফাংশন ব্যবহার করে তৈরি করা হয়, যা অত্যন্ত জটিল এবং অনুমান নির্ভর। মাইনারদের লক্ষ্য থাকে সঠিক হ্যাশ মান খুঁজে বের করা, যা ব্লকের ডাটা এবং নেটওয়ার্কের পূর্ববর্তী ব্লকের সাথে মিলে যায়। এই সমস্যাগুলোর সমাধান করার জন্য প্রচুর পরিমাণে কম্পিউটিং শক্তি এবং সময় লাগে। এর মাধ্যমে ব্লক তৈরি ও নেটওয়ার্কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।

দ্বিতীয়ত- জটিল সমস্যার কারণে ব্লক তৈরি করা সহজ নয়, ফলে নেটওয়ার্ক নিরাপদ থাকে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি ব্লকচেইন পরিবর্তন করতে চায়, তাহলে তাদের নেটওয়ার্কের মোট কম্পিউটিং শক্তির ৫১% নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। এখানে কম্পিউটিং শক্তি নিয়ন্ত্রণ বলতে বোঝানো হয় যে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যদি ব্লকচেইন সিস্টেমে পরিবর্তন আনতে চায়, তাহলে তাদেরকে নেটওয়ার্কের মোট মাইনিং ক্ষমতার অর্ধেকেরও বেশি অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এটি অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। আর এটির জন্যই  ব্লকচেইনের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

শেষ অংশ-প্রতিটি সফল ব্লকের জন্য মাইনাররা ক্রিপ্টোকারেন্সিতে পুরস্কার পান, যেমন বিটকয়েন। এই পুরস্কার মূলত ব্লকের মধ্যে থাকা ট্রানজ্যাকশন ফি এবং নতুনভাবে তৈরি করা কয়েন নিয়ে গঠিত। এটি মাইনিংকে লাভজনক করে তোলে এবং মাইনারদেরকে ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে কাজ করতে উৎসাহিত করে। এই প্রক্রিয়া শুধুমাত্র মাইনারদের জন্য আর্থিক লাভজনক নয় বরং নেটওয়ার্কের ক্রিয়াশীলতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও সাহায্য করে।

সুবিধা

  • PoW-এর কারণে ব্লকচেইনে হ্যাক করা অত্যন্ত কঠিন।
  • এটি ক্রিপ্টোকারেন্সি সিস্টেমের জন্য একটি পরীক্ষিত এবং নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

অসুবিধা

  • PoW পদ্ধতিতে মাইনিং করতে প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন।
  • প্রতি সেকেন্ডে কম লেনদেন সমর্থন করে (যেমন, বিটকয়েন ৭ টি লেনদেন/সেকেন্ড)।
  • মাইনিং পুল বা বড় বড় কোম্পানিগুলো মাইনিং শক্তির একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।

প্রুফ অফ স্টেক (PoS) কী?

প্রুফ অফ স্টেক (PoS) হলো PoW-এর একটি বিকল্প এবং পরিবেশবান্ধব কনসেনসাস পদ্ধতি। এখানে নেটওয়ার্কের অংশগ্রহণকারীরা তাদের ক্রিপ্টোকারেন্সি লক করে বা “স্টেক” করে ব্লক তৈরি এবং লেনদেন যাচাই করে।

কীভাবে এটি কাজ করে?

প্রথম- নেটওয়ার্কের অংশগ্রহণকারীরা তাদের ক্রিপ্টোকারেন্সি একটি নির্দিষ্ট সময়ের জন্য লক করে রাখে, যাকে “স্টেকিং” বলা হয়। এটি একটি প্রক্রিয়া যেখানে ব্যবহারকারীরা তাদের নিজস্ব সম্পদ নেটওয়ার্কে অবদান হিসেবে জমা দেয়। এই স্টেকিং এর মাধ্যমে তারা নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করে এবং নতুন ব্লক তৈরির সুযোগ পায়। যারা বেশি পরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সি স্টেক করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে ধরে রাখে, তাদের ভেরিফায়ার বা ব্লক প্রস্তাবকারী হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। এটি ব্লকচেইনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং কার্যকারিতা বজায় রাখতে সাহায্য করে।

দ্বিতীয়- নেটওয়ার্ক এলগরিদম অনুযায়ী, অংশগ্রহণকারীদের মধ্য থেকে এলোমেলোভাবে একজন বা একাধিক ভেরিফায়ার নির্বাচন করা হয়। যারা বেশি ক্রিপ্টোকারেন্সি স্টেক করে এবং দীর্ঘ সময় ধরে তা ধরে রাখে, তাদের ভেরিফায়ার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

তৃতীয়- সফলভাবে ব্লক ভেরিফাই করার পর ভেরিফায়াররা নেটওয়ার্কের কার্যক্রমে তাদের অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ট্রানজ্যাকশন ফি বা নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি দ্বারা পুরস্কৃত হয়। ট্রানজ্যাকশন ফি হলো লেনদেন সম্পন্ন করার জন্য ব্যবহারকারীরা প্রদান করা ফি, যা ভেরিফায়ারের আয়ের একটি অংশ হিসেবে যুক্ত হয়। অন্যদিকে, নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি হলো ব্লক তৈরি প্রক্রিয়ায় সিস্টেম কর্তৃক মুদ্রিত অতিরিক্ত কয়েন, যা ভেরিফায়ারদের কাজের পুরস্কার হিসেবে দেওয়া হয়। এটি ভেরিফায়ারদের অংশগ্রহণকে আরও উৎসাহিত করে এবং নেটওয়ার্কের নিরাপত্তা ও কার্যকারিতা বজায় রাখে।

সুবিধা

  • PoS পদ্ধতিতে PoW-এর তুলনায় অনেক কম শক্তি লাগে।
  • PoS পদ্ধতিতে প্রতি সেকেন্ডে বেশি লেনদেন প্রক্রিয়া করা যায়। উদাহরণস্বরূপ, ইথেরিয়াম ২.০ PoS-এ স্থানান্তরিত হওয়ার পরে স্কেলেবিলিটি বেড়েছে।
  • অংশগ্রহণকারীদের মাইনিং যন্ত্রের প্রয়োজন হয় না, ফলে এটি তুলনামূলক সাশ্রয়ী।

অসুবিধা

  • বড় অংশগ্রহণকারীরা অধিক পরিমাণ ক্রিপ্টোকারেন্সি স্টেক করতে পারে, যা সিস্টেমকে কিছুটা কেন্দ্রীভূত করে তুলতে পারে।
  • PoS তুলনামূলক নতুন, ফলে এর নিরাপত্তা নিয়ে কিছু প্রশ্ন থেকে যায়।

PoW এবং PoS এর মধ্যে পার্থক্য

বৈশিষ্ট্যপ্রুফ অফ ওয়ার্ক (PoW)প্রুফ অফ স্টেক (PoS)
শক্তি খরচখুব বেশিখুব কম
স্কেলেবিলিটিসীমিতবেশি
নিরাপত্তাঅত্যন্ত উচ্চনির্ভরযোগ্য
লেনদেন গতিধীরদ্রুত
পরিবেশের প্রভাবনেতিবাচকইতিবাচক
PoW এবং PoS উভয়ই ব্লকচেইন প্রযুক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কনসেনসাস মেকানিজম। PoW তার নিরাপত্তা এবং নির্ভরযোগ্যতার জন্য জনপ্রিয়, যেখানে PoS তার শক্তি দক্ষতা এবং স্কেলেবিলিটির জন্য ভবিষ্যৎমুখী একটি পদ্ধতি। ক্রিপ্টোকারেন্সি ইকোসিস্টেমের ভবিষ্যৎ বিকাশে উভয় পদ্ধতিরই নির্দিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। তবে, পরিবেশগত প্রভাব এবং স্কেলেবিলিটির কারণে অনেক নতুন প্রকল্প PoS পদ্ধতি গ্রহণ করছে।

ব্লকচেইন নোড কি? নোড এর মাধ্যমে কিভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং করা হয়?

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো