নোড বলতে এমন একটি ডিভাইস বা সফটওয়্যারকে বোঝানো হয় যা কোনো নেটওয়ার্কের অংশ হিসেবে কাজ করে এবং সেই নেটওয়ার্কের তথ্য আদান-প্রদান বা সংরক্ষণে ভূমিকা রাখে। ব্লকচেইনের ক্ষেত্রে, প্রতিটি নোড একটি ডেটাবেসের অংশ হিসেবে কাজ করে এবং লেনদেনের তথ্যগুলো সংরক্ষণ ও যাচাই করে। এটি ব্লকচেইন নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, কারণ নোডগুলোর মাধ্যমে নেটওয়ার্কের ডেটা সুরক্ষিত ও বন্টনযোগ্য থাকে। ব্লকচেইন নেটওয়ার্কে নোড দুটি প্রধান কাজ করে থাকে: প্রথমত, লেনদেনের তথ্য গ্রহণ এবং যাচাই করা এবং দ্বিতীয়ত, ব্লকচেইনের হালনাগাদ কপি সংরক্ষণ করা। নোডগুলো পারস্পরিক সংযোগের মাধ্যমে একটি বিকেন্দ্রীভূত (decentralized) ব্যবস্থা তৈরি করে, যা কোনো একক কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই কাজ করতে পারে। আজ এই প্রবন্ধটিতে আমরা নোড এবং নোড এর মাধ্যমে কিভাবে ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং করা হয় এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করবো। নিম্নে নোডের বিভিন্ন ধরণ নিয়ে আলাচনা করা হলো-
আরও পড়ুনঃ ব্লকচেইন টেকনোলজি কি? ব্লকচেইনের পুরো ইতিহাস
১) ফুল নোড (Full Node):
- ব্লকচেইনের সম্পূর্ণ ইতিহাস (প্রতিটি ব্লক ও লেনদেন) সংরক্ষণ করে।
- সমস্ত লেনদেন ও ব্লক স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করে নেটওয়ার্কের নিয়ম (কনসেনসাস প্রোটোকল) প্রয়োগ করে।
- উদাহরণ: Bitcoin Core সফটওয়্যার দ্বারা চালিত নোড।
২) লাইট নোড (Light Node বা SPV Node):
- ব্লকচেইনের সম্পূর্ণ ডেটা সংরক্ষণ না করে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় তথ্য (যেমন ব্লক হেডার) রাখে।
- লেনদেন যাচাইয়ের জন্য ফুল নোডের উপর নির্ভরশীল।
- সাধারণত মোবাইল ওয়ালেটে ব্যবহৃত হয়।
৩) মাইনিং নোড (Mining Node):
- বিশেষ হার্ডওয়্যার (ASIC, GPU) ব্যবহার করে ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিংয়ে অংশ নেয়।
- নতুন ব্লক তৈরি ও নেটওয়ার্কে যোগ করার জন্য গণনামূলক সমস্যা সমাধান করে।
- Bitcoin-এর মতো Proof of Work (PoW) ভিত্তিক নেটওয়ার্কে সক্রিয়।
৪) মাস্টারনোড (Masternode):
- কিছু ক্রিপ্টোকারেন্সিতে (যেমন Dash) ব্যবহৃত হয়।
- বিশেষ সুবিধা প্রদান করে, যেমন প্রাইভেট লেনদেন বা তাত্ক্ষণিক লেনদেন।
- মাস্টারনোড চালাতে সাধারণত নির্দিষ্ট পরিমাণ কোইন স্টেকিং প্রয়োজন।
ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং কী এবং নোডের ভূমিকা
মাইনিং হলো ব্লকচেইনে নতুন লেনদেন যুক্ত করার প্রক্রিয়া, যেখানে মাইনাররা গণনামূলক শক্তি ব্যবহার করে নেটওয়ার্ক সুরক্ষিত করে এবং রিওয়ার্ড পায়। এই প্রক্রিয়ায় নোডগুলোর ভূমিকা নিম্নরূপ:
মাইনিং প্রক্রিয়ার ধাপসমূহ:
১) লেনদেন সংগ্রহ (Transaction Pool):
- মাইনিং নোডগুলি নেটওয়ার্ক থেকে লেনদেন সংগ্রহ করে এবং একটি ট্রানজাকশন পুলে (মেমপুল) জমা করে।
- লেনদেনের বৈধতা যাচাই করে (যেমন ডিজিটাল সিগনেচার, ডাবল স্পেন্ডিং চেক)।
২) ব্লক গঠন (Block Creation):
- বৈধ লেনদেনগুলিকে একটি ব্লকে সংযুক্ত করে। প্রতিটি ব্লকে একটি হেডার থাকে, যাতে পূর্ববর্তী ব্লকের হ্যাশ, মার্কেল রুট (লেনদেনের সারাংশ), এবং একটি নন্স (এলোমেলো সংখ্যা) অন্তর্ভুক্ত থাকে।
৩) প্রুফ অব ওয়ার্ক (PoW) সমাধান:
- মাইনিং নোডগুলি একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ (যেমন SHA-256 Bitcoin-এ) খুঁজে বের করতে প্রতিযোগিতা করে।
- লক্ষ্য হলো এমন একটি নন্স খুঁজে বের করা যার ফলে ব্লক হেডারের হ্য� নেটওয়ার্ক দ্বারা নির্ধারিত টার্গেট (Difficulty) এর চেয়ে কম হয়।
- এই প্রক্রিয়ার জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন হার্ডওয়্যার (ASIC, GPU) প্রয়োজন।
৪) ব্লক নেটওয়ার্কে প্রচার:
- সফল মাইনার নতুন ব্লকটি নেটওয়ার্কে ব্রডকাস্ট করে। অন্যান্য নোডগুলি ব্লকটি যাচাই করে (যেমন হ্যাশ টার্গেট পূরণ, লেনদেনের বৈধতা)।
৫) ব্লকচেইনে যুক্তকরণ:
- যদি ৫১% এর বেশি নোড ব্লকটিকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেয়, তবে এটি ব্লকচেইনে যুক্ত হয়।
- মাইনারকে ব্লক রিওয়ার্ড (নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি) এবং লেনদেন ফি দেওয়া হয়।
আরও পড়ুনঃ ওয়েব ৩.০ পরবর্তী প্রজন্মের ইন্টারনেট যা থাকবে আপনার নিয়ন্ত্রণে
নোডের মাধ্যমে মাইনিংয়ের প্রযুক্তিগত বিবরণ
ক্রিপ্টোকারেন্সি মাইনিং হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে জটিল গাণিতিক সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে নতুন ব্লক তৈরি করা হয় এবং এটি ব্লকচেইনে যুক্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় নোড একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মাইনিংয়ের সময় নোড এমনভাবে কাজ করে যেন এটি ব্লকচেইনের লেনদেন যাচাই এবং বৈধতা প্রদান করতে পারে। মাইনিং প্রক্রিয়ায় যে গাণিতিক সমস্যাগুলো সমাধান করা হয়, সেগুলো আসলে একটি ক্রিপ্টোগ্রাফিক হ্যাশ ফাংশন।
মাইনিংয়ের জন্য, নোড প্রথমে লেনদেনের একটি তালিকা সংগ্রহ করে। এরপর নোড এই লেনদেনগুলোকে একটি ব্লকে সাজিয়ে ফেলে। প্রতিটি ব্লকের একটি শিরোনাম থাকে, যেখানে পূর্ববর্তী ব্লকের হ্যাশ, টাইমস্ট্যাম্প, এবং অন্যান্য তথ্য অন্তর্ভুক্ত থাকে। নোডটি এরপর ব্লকটির জন্য একটি বৈধ হ্যাশ মান খুঁজতে শুরু করে। এটি প্রুফ-অব-ওয়ার্ক (Proof-of-Work) প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয়। প্রুফ-অব-ওয়ার্ক হলো একটি প্রক্রিয়া যেখানে একটি নির্দিষ্ট মানের চেয়ে কম মানের একটি হ্যাশ খুঁজে বের করতে কম্পিউটার প্রচুর পরিমাণে গণনা করে।
যখন একটি নোড সফলভাবে একটি বৈধ হ্যাশ খুঁজে পায়, তখন এটি সেই ব্লকটিকে নেটওয়ার্কের অন্য নোডগুলোর কাছে সম্প্রচার করে। অন্য নোডগুলো তখন সেই ব্লকটি যাচাই করে দেখে যে এটি বৈধ কি না। যদি ব্লকটি বৈধ হয়, তবে সেটি ব্লকচেইনে যুক্ত হয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটি নেটওয়ার্কের স্বচ্ছতা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করে।
মাইনিংয়ের জন্য শক্তিশালী হার্ডওয়্যার এবং প্রচুর বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এটি সাধারণত বিশেষায়িত ডিভাইস যেমন ASIC (Application-Specific Integrated Circuit) মাইনার বা শক্তিশালী GPU (Graphics Processing Unit) ব্যবহার করে সম্পন্ন হয়। একটি নোড শুধুমাত্র মাইনিং করার জন্য কাজ করে না; এটি ব্লকচেইনের একটি কপি সংরক্ষণ এবং নেটওয়ার্কের অন্যান্য নোডের সাথে যোগাযোগ করার কাজও করে।
মাইনিংয়ের মাধ্যমে নতুন ক্রিপ্টোকারেন্সি তৈরি হয় এবং মাইনিং প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারীরা ব্লক তৈরি করার জন্য পুরস্কার হিসেবে ক্রিপ্টোকারেন্সি পায়। এটি ব্লকচেইন নেটওয়ার্ককে পরিচালিত রাখার জন্য একটি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া।
চ্যালেঞ্জ
- শক্তি খরচ: Bitcoin মাইনিং বিশ্বব্যাপী বছরে ~১২১ টেরাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার করে, যা পরিবেশগত উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
- কেন্দ্রীকরণ ঝুঁকি: বড় মাইনিং পুলগুলির হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সম্ভাবনা (যেমন AntPool, Foundry USA)।
- হার্ডওয়্যার ব্যয়: ASIC মেশিনের দাম কয়েক হাজার থেকে লক্ষ ডলার পর্যন্ত হতে পারে।
নোড এবং মাইনিং ক্রিপ্টোকারেন্সি নেটওয়ার্কের মেরুদণ্ড। নোডগুলি নেটওয়ার্কের স্বচ্ছতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, আর মাইনিং নোডগুলি লেনদেন প্রক্রিয়াকরণ ও নতুন কোইন প্রবর্তনে ভূমিকা রাখে। তবে শক্তি সাশ্রয়ী বিকল্প হিসাবে Proof of Stake (Ethereum 2.0, Cardano) এর মতো মডেলগুলি ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয় হচ্ছে। এই প্রযুক্তির বিবর্তন ডিজিটাল অর্থনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।