ডাইমেনশন বলতে কোনো বস্তুর দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা বা গভীরতার পরিমাপ বোঝায়। এটি এমন একটি পরিমাণ যা স্থান বা বস্তুর শারীরিক গঠনকে সংজ্ঞায়িত করতে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত ডাইমেনশন শব্দটি জ্যামিতি, পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়। তবে উচ্চতর ডাইমেনশনগুলো মহাবিশ্বকে বুঝতে এবং ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। এটি বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় ব্যবহৃত হয়, বিশেষত পদার্থবিদ্যা এবং গণিতে। মহাবিশ্ব এবং তার গঠন সম্পর্কে আমাদের যে সাধারণ ধারণা রয়েছে, তার মধ্যে তিনটি স্থানীয় ডাইমেনশন এবং আর একটি সময় ডাইমেনশনে সীমাবদ্ধ। তবে থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সের স্ট্রিং থিওরি এবং তার উন্নততর সংস্করণ এম-থিওরি-এ মোট ১১টি ডাইমেনশনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এই অতিরিক্ত ডাইমেনশনগুলো আমাদের দৃষ্টির বাইরে এবং এগুলো কল্পনা করতে গেলে আমাদের প্রচলিত ধারণার বাইরে যেতে হবে। এই তত্ত্বগুলো মহাবিশ্বের গঠন এবং তার মৌলিক বলগুলোর একীকরণ ঘটাতে সাহায্য করে। আজ আমরা মূলত ১১তম ডাইমেনশন কি সেটা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করব। তবে প্রথমে সংক্ষেপে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত ডাইমেনশনগুলো সম্পর্কে যেনে নিবো এতে করে ১১তম ডাইমেনশন সম্পর্কে বুঝতে আমাদের সুবিধা হবে।
আরও পড়ুনঃ এলিয়েন কি সত্যি আছে? কোরআন ও বিজ্ঞান কি বলে জেনে নিন
১ম ডাইমেনশন (১ডি)
একমাত্রা বা ১ম ডাইমেনশন এমন একটি মাত্রা যেখানে কোনো বস্তুর অবস্থান শুধুমাত্র একটি পরিমাপ দ্বারা নির্ধারণ করা হয়। এটি সাধারণত একটি সরল রেখা হিসাবে কল্পনা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি সরল রাস্তায় একটি গাড়ির অবস্থান বোঝাতে শুধুমাত্র দূরত্ব ব্যবহার করা হয়। একমাত্রা জগতে দৈর্ঘ্য ছাড়া অন্য কোনো পরিমাপের প্রয়োজন নেই।
২য় ডাইমেনশন (২ডি)
২য় ডাইমেনশনে দৈর্ঘ্য এবং প্রস্থ উভয়ই বিবেচনা করা হয়। এটি একটি সমতল ক্ষেত্র বা পৃষ্ঠকে বোঝায়। উদাহরণস্বরূপ, একটি কাগজের পৃষ্ঠ বা একটি চিত্র। এখানে একটি বস্তুর অবস্থান নির্ধারণ করতে দুটি পরিমাপ প্রয়োজন হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটি মানচিত্রে অবস্থান চিহ্নিত করার জন্য ‘x’ এবং ‘y’ অক্ষ ব্যবহার করা হয়।
৩য় ডাইমেনশন (৩ডি)
৩য় ডাইমেনশন যেখানে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, এবং উচ্চতা (বা গভীরতা) বিবেচনা করা হয়। এটি আমাদের দৈনন্দিন জগতের সবচেয়ে সাধারণ উপস্থাপনা। উদাহরণস্বরূপ, একটি ঘনক বা একটি গাছ। ৩ ডাইমেনশনে কোনো বস্তুর অবস্থান নির্ধারণ করতে তিনটি অক্ষ (x, y, z) ব্যবহার করা হয়।
৪র্থ ডাইমেনশন (৪ডি)
৪র্থ ডাইমেনশন ৩য় ডাইমেনশনের সঙ্গে সময় যোগ করে। এটাকে টাইম ডাইমেনশনও বলা হয়। এটি মূলত আইনস্টাইনের আপেক্ষিক তত্ত্বে ব্যবহৃত হয়। এখানে সময়কে একটি অতিরিক্ত মাত্রা হিসেবে বিবেচনা করা হয় যা মহাবিশ্বের বিভিন্ন ঘটনার সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করে। উদাহরণস্বরূপ, একটি গাড়ি যে সময়ে নির্দিষ্ট একটি স্থানে পৌঁছেছে তা বোঝাতে ৪র্থ ডাইমেনশন প্রয়োজন।
৫ম ডাইমেনশন (৫ডি)
৫ম ডাইমেনশন এটি আমাদের পরিচিত চারটি মাত্রার বাইরের একটি অতিরিক্ত মাত্রা হিসেবে বিবেচিত হয়। সুপারস্ট্রিং তত্ত্বে ৫ম ডাইমেনশনকে এমন একটি স্থান হিসেবে কল্পনা করা হয়, যা মহাবিশ্বের বিভিন্ন বাস্তবতা বা সমান্তরাল স্তরের সাথে সংযোগ ঘটায়। কিছু আধ্যাত্মিক বিশ্বাসে এটি সময়, স্থান এবং পদার্থের সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করার জন্য একটি উচ্চতর চেতনার স্তর হিসেবে ধরা হয়। এটি এখনো তাত্ত্বিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এর প্রকৃতি বোঝার জন্য আরও গবেষণা প্রয়োজন।
পৃথিবীর এমন কিছু অদ্ভুত জায়গা যেখানে মাধ্যাকর্ষণ কাজ করে না!
৬ষ্ঠ ডাইমেনশন (৬ডি)
ষষ্ঠমাত্রা একটি নির্দিষ্ট সূচনা বিন্দু থেকে বিকল্প বাস্তবতাগুলির বিভিন্ন উপায়ে পরিবর্তন হতে পারে। এটি একটি সুতোয় বাঁধা বিভিন্ন পৃথিবী বা মহাবিশ্বের মতো কল্পনা করা যেতে পারে। ষষ্ঠমাত্রায়, আমরা কেবল বিকল্প বাস্তবতা কল্পনা করি না, বরং সেই বিকল্প বাস্তবতার মধ্যে যাতায়াতও কল্পনা করতে পারি।
৭ম ডাইমেনশন (৭ডি)
সপ্তমমাত্রা একটি স্তর, যেখানে সমস্ত সম্ভাব্য মহাবিশ্ব এবং তাদের শুরু এবং শেষের পরিপ্রেক্ষিতে ধারণা করা হয়। এটি বিভিন্ন মহাবিশ্বের মধ্যে পার্থক্য এবং তাদের বিকাশ ব্যাখ্যা করতে ব্যবহৃত হয়। সপ্তমমাত্রার ধারণা অত্যন্ত তত্ত্বীয় এবং এর কোনো সরাসরি প্রমাণ নেই।
৮ম ডাইমেনশন (৮ডি)
অষ্টমমাত্রায়, বিভিন্ন মহাবিশ্বের মধ্যে সম্পর্ক আরও জটিল এবং বহুমুখী হয়। এটি আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান এবং বিশেষত সুপারস্ট্রিং তত্ত্ব বা এম-তত্ত্বের (এম-থিওরি) একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, মহাবিশ্বের প্রকৃতি এবং কাজ বোঝার জন্য অতিরিক্ত মাত্রা প্রয়োজন। ৮ম ডাইমেনশনে এমন বাস্তবতাগুলি থাকতে পারে, যা আমাদের চেনা মহাবিশ্বের বাইরে এবং যেখানে বিভিন্ন প্রাকৃতিক নিয়ম নতুনভাবে কাজ করে। এই মাত্রাটি এমন একটি স্থান হিসেবে কল্পনা করা হয়, যেখানে সমস্ত সম্ভাব্য শারীরিক আইন এবং গাণিতিক কাঠামো অস্তিত্বশীল।
৯ম ডাইমেনশন (৯ডি)
৯ম ডাইমেনশনকে এমন একটি স্তর হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, যেখানে মহাবিশ্বের সমস্ত সমান্তরাল স্তর বা বিকল্প বাস্তবতার সম্ভাবনা একসঙ্গে বিদ্যমান। এটি এমন একটি জায়গা হতে পারে যেখানে আমাদের মহাবিশ্বের চেনা শারীরিক নিয়ম আর প্রযোজ্য নয়। এই মাত্রাটি মহাবিশ্বের একাধিক বিন্দুকে সংযুক্ত করার বা অন্য মাত্রাগুলোর চেয়ে উচ্চতর বাস্তবতাগুলোর মধ্যস্থতা করার একটি মাধ্যম হতে পারে।
১০ম ডাইমেনশন (১০ডি)
দশমমাত্রা হলো সমস্ত কিছুর তত্ত্বের (থিওরি অফ এভরিথিং) একটি কেন্দ্রবিন্দু। এটি এমন একটি স্তর যেখানে সমস্ত স্ট্রিং তত্ত্ব একত্রিত হয় এবং একক একটি কাঠামো তৈরি করে। দশমমাত্রা বোঝার মাধ্যমে আমরা মহাবিশ্বের কার্যপদ্ধতি এবং এর অস্তিত্ব সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করতে পারি।
১১তম ডাইমেনশন (১১ডি)
একাদশ ডাইমেনশন হলো এম-থিওরি (M-Theory) এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। এখানে বলা হয়েছে যে একাদশ ডাইমেনশন সমস্ত স্ট্রিং থিওরি এবং তার বিভিন্ন সংস্করণের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের মূল ভিত্তি। এই স্তরে, আমরা শুধু স্ট্রিং নয়, বরং ঝিল্লি বা ব্রেন নামক মাল্টি-ডাইমেনশনাল বস্তু কল্পনা করি। এই ব্রেনগুলো মহাবিশ্বের গঠন এবং তার বিভিন্ন বলের মধ্যে সম্পর্ক তৈরি করে। এই অতিরিক্ত ডাইমেনশনগুলোর কাজ বুঝতে গেলে আমাদের প্রচলিত বিজ্ঞানের বাইরে যেতে হবে। স্ট্রিং থিওরি এবং এম-থিওরি অনুযায়ী মহাবিশ্বের সমস্ত মৌলিক বল (যেমন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিজম, গ্রাভিটি, এবং নিউক্লিয়ার বল) একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। এই অতিরিক্ত ডাইমেনশনগুলো ছাড়া এই সংযোগ ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, গ্রাভিটি অন্যান্য বলের তুলনায় এত দুর্বল কেন? এই প্রশ্নের উত্তর স্ট্রিং থিওরি এমনভাবে ব্যাখ্যা করে যে, গ্রাভিটি কেবল আমাদের চেনা তিন-মাত্রার জগতে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি অতিরিক্ত ডাইমেনশনগুলোতেও ছড়িয়ে আছে। এই ধারণা অনুযায়ী, মহাবিশ্বের অতিরিক্ত ডাইমেনশনগুলোতে গ্রাভিটির একটি বড় অংশ কার্যকর হয়, ফলে আমাদের কাছে এটি তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়।
স্ট্রিং থিওরি এবং এম-থিওরি এখনো পরীক্ষামূলকভাবে প্রমাণিত হয়নি। তবে এই তত্ত্বগুলো আমাদের মহাবিশ্বের গঠন এবং তার মৌলিক কাজ করার পদ্ধতি বোঝার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধারণাগুলো কোয়ান্টাম মেকানিক্স এবং আপেক্ষিক তত্ত্বের মধ্যে ফাঁক পূরণ করতে পারে। অতিরিক্ত ডাইমেনশনগুলো আমাদের বর্তমান বিজ্ঞানের সীমা অতিক্রম করে নতুন এক জগৎ প্রকাশ করার প্রতিশ্রুতি দেয়। এটি এমন একটি জগৎ যেখানে সমস্ত বাস্তবতা, সম্ভাবনা এবং মহাবিশ্বের মূল রহস্য লুকিয়ে রয়েছে।
পৃথিবীতে জীবনের শুরু কীভাবে হলো? বিজ্ঞানীরা এবার নতুন এক তথ্য খোঁজে পেলো
এম-থিওরি কি?
এম-থিওরি হলো একটি উন্নত তাত্ত্বিক ধারণা, যা স্ট্রিং থিওরির ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণগুলোর (যেমন Type I, Type IIA, Type IIB, Heterotic SO(32), এবং Heterotic E8×E8) মধ্যে সংযোগ ঘটানোর চেষ্টা করে। এটি মহাবিশ্বের মৌলিক গঠন ও কাজ করার প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করতে চায়। এম-থিওরি মূলত বলে, মহাবিশ্বে শুধুমাত্র ১০টি নয়, বরং ১১তম ডাইমেনশন রয়েছে। অতিরিক্ত ডাইমেনশন যোগ করার মাধ্যমে এটি স্ট্রিং থিওরির সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে এবং একটি আরও সাধারণ কাঠামো তৈরি করে। এম-থিওরি এর “এম” এর পুরো অর্থ নিয়ে একাধিক ব্যাখ্যা রয়েছে:
- “Membrane” (ঝিল্লি): কারণ, এম-থিওরি স্ট্রিং ছাড়াও উচ্চতর মাত্রার বস্তু (যেমন ২-মাত্রার ঝিল্লি বা ৩-মাত্রার ব্রেন) নিয়ে কাজ করে।
- “Magic” (জাদু): এর জটিলতা এবং সম্ভাব্য ব্যাখ্যার জন্য একে মাঝে মাঝে জাদুকরী বলা হয়।
- “Mystery” (রহস্য): কারণ, এটি এখনো পুরোপুরি বোঝা যায়নি এবং অনেক প্রশ্নের উত্তর অজানা।
- “Master” (মাস্টার): এটি সমস্ত স্ট্রিং থিওরির একীকরণ (unification) ঘটায়।
এম-থিওরি একটি তাত্ত্বিক কাঠামো, যা বলে মৌলিক কণা আসলে ছোট স্ট্রিং নয়, বরং মাল্টি-ডাইমেনশনাল ব্রেন। ১১তম ডাইমেনশন স্পেসটাইমের (স্থান ও সময়ের) গঠনকে আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
এম-থিওরি-এর গুরুত্ব
- গ্রাভিটি ও অন্যান্য মৌলিক বলগুলোর একীকরণ ঘটানো।
- বিগ ব্যাং এবং মহাবিশ্বের সৃষ্টির কারণ ব্যাখ্যা করা।
- মাল্টিভার্স বা একাধিক মহাবিশ্বের ধারণা ব্যাখ্যা করা।
এম-থিওরি এখনো একটি তাত্ত্বিক ধারণা এবং এটি পরীক্ষা বা প্রমাণ করার জন্য কোনো সরাসরি উপায় এখনো পাওয়া যায়নি। তবে এটি ফিজিক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার একটি ক্ষেত্র।
ডাইমেনশন বা মাত্রাগুলি মহাবিশ্বের জটিলতাকে ব্যাখ্যা করার একটি উপায়। একমাত্রা থেকে একাদশমাত্রা পর্যন্ত প্রতিটি স্তর আমাদেরকে নতুন নতুন ধারণা এবং সম্ভাবনার জগতে নিয়ে যায়। যদিও এগুলোর মধ্যে অনেক কিছুই তত্ত্বগত, তবুও এসব ধারণা বিজ্ঞানের অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভবিষ্যতে এসব মাত্রা সম্পর্কে আরও গবেষণা এবং প্রমাণ আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীরতর জ্ঞান প্রদান করবে।