মঙ্গল গ্রহ কেন লাল? নতুন এক তথ্য দিলো বিজ্ঞানীরা

মঙ্গল গ্রহের লাল রঙের রহস্য বহু বছর ধরে বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল। এতদিন ধরে মনে করা হতো যে, মঙ্গলের লালচে বর্ণের জন্য দায়ী প্রধানত হেমাটাইট নামের এক ধরনের লৌহ অক্সাইড, যা শুষ্ক অবস্থায় মরিচার মতো তৈরি হয়। তবে সাম্প্রতিক এক গবেষণা নতুন একটি তথ্য উঠে এসেছে। নতুন গবেষণা বলছে, মঙ্গলের ধুলোতে মূলত ফেরিহাইড্রাইট নামের এক ধরনের খনিজ রয়েছে, যা পানির উপস্থিতিতে গঠিত হয়। এই আবিষ্কার মঙ্গলের অতীত সম্পর্কে নতুন ধারণা দিচ্ছে এবং ইঙ্গিত দিচ্ছে যে গ্রহটি একসময় অনেক বেশি আর্দ্র এবং বাসযোগ্য ছিল।

মঙ্গলের লাল রঙের কারণ

মঙ্গলের উজ্জ্বল লাল বর্ণ অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীদের জন্য একটি রহস্য ছিল। এই গ্রহের অনন্য রঙের জন্য একে “রেড প্ল্যানেট” বা লাল গ্রহ বলা হয়। এতদিন ধরে প্রচলিত তত্ত্ব ছিল যে, মঙ্গলের লাল রঙ মূলত শুকনো লৌহ অক্সাইড বা হেমাটাইট থেকে এসেছে। কিন্তু নতুন গবেষণায় দেখা গেছে, মঙ্গলের ধূলিকণায় প্রকৃতপক্ষে ফেরিহাইড্রাইট বেশি পরিমাণে বিদ্যমান, যা সাধারণত পানির উপস্থিতিতে গঠিত হয়।

সম্প্রতি নেচার কমিউনিকেশনস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় ব্রাউন ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব বার্ন-এর বিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন যে, মঙ্গলের লালচে ধুলোতে ফেরিহাইড্রাইট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এই গবেষণায় মঙ্গলের কক্ষপথে থাকা বিভিন্ন উপগ্রহ, রোভার এবং ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে।

গবেষক আদোমাস ভ্যালান্টিনাস বলেন, “আমরা আগেও অনুমান করেছি যে ফেরিহাইড্রাইট মঙ্গলের লাল রঙের কারণ হতে পারে, কিন্তু এটি কখনো নিশ্চিত করা যায়নি। এবার আমরা পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য ও পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত করেছি যে ফেরিহাইড্রাইটই মঙ্গলের ধূলিকণার মূল উপাদান।”

ফেরিহাইড্রাইট কি?

ফেরিহাইড্রাইট হলো একটি লৌহ অক্সাইড যা সাধারণত পানির উপস্থিতিতে গঠিত হয়। পৃথিবীতে এটি আগ্নেয় শিলা বা ছাইয়ের ক্ষয়ের ফলে তৈরি হয়। এতদিন ধরে মনে করা হচ্ছিল, মঙ্গলের পৃষ্ঠে শুধুমাত্র শুষ্ক পরিবেশেই লালচে ধুলো তৈরি হয়েছে। কিন্তু ফেরিহাইড্রাইটের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, একসময় মঙ্গলে পানি ছিল এবং সম্ভবত তা কয়েক বিলিয়ন বছর আগে গ্রহের পৃষ্ঠকে আর্দ্র করে রেখেছিল।

বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এই গবেষণা মঙ্গলের অতীত জলবায়ু বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সাধারণত হেমাটাইট গরম ও শুষ্ক পরিবেশে গঠিত হয়, কিন্তু ফেরিহাইড্রাইটের জন্য ঠান্ডা ও আর্দ্র পরিবেশের প্রয়োজন। তাই মঙ্গলের লাল রঙ যদি মূলত ফেরিহাইড্রাইট থেকে আসে, তবে এটি প্রমাণ করে যে একসময় গ্রহটিতে প্রচুর পরিমাণে তরল পানি ছিল।

মঙ্গলের অতীত

বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন যে, মঙ্গল গ্রহ কখনো প্রাণ ধারণের উপযোগী ছিল কিনা। গবেষক ভ্যালান্টিনাস বলেন, “আমরা শুধু অতীত নয়, মঙ্গলের বর্তমান রাসায়নিক পরিবর্তন সম্পর্কেও জানতে চাই। এই খনিজ গঠনের সময়কার পরিবেশ বুঝতে পারলে আমরা জানতে পারব, তখনকার জলবায়ু কেমন ছিল।”

এই গবেষণায় বিজ্ঞানীরা নাসার মঙ্গল রিকনাইসেন্স অরবিটার এবং ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির মঙ্গল এক্সপ্রেস ও ট্রেস গ্যাস অরবিটারের তথ্য ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি, কিউরিওসিটি, পাথফাইন্ডার ও অপরচুনিটি রোভার থেকে পাওয়া মাটির নমুনার পর্যালোচনা করা হয়েছে। এই উপগ্রহ এবং রোভারগুলোর সরবরাহকৃত ডেটা থেকে মঙ্গলের ধূলিকণার বিশ্লেষণ করা হয়। পরে বিজ্ঞানীরা ল্যাবরেটরিতে মঙ্গলের ধূলিকণার অনুরূপ কণা তৈরি করে তা পরীক্ষা করেন।

পরীক্ষাগারে মঙ্গলের ধূলিকণা তৈরির প্রক্রিয়া

গবেষকরা জানিয়েছেন, “মঙ্গলের ধূলিকণা খুবই সূক্ষ্ম, তাই আমরা পরীক্ষাগারে এমন একটি মিশ্রণ তৈরি করেছি যা মঙ্গলের আসল ধুলোর মতো আচরণ করে। আমরা বিশেষ যন্ত্রের মাধ্যমে ফেরিহাইড্রাইট ও আগ্নেয় শিলার কণাগুলোকে অত্যন্ত ক্ষুদ্র আকারে পরিণত করেছি।” এই কণাগুলোর আকার ছিল মানুষের চুলের একশ ভাগের এক ভাগ, যা মঙ্গলের ধুলোকে বাস্তবসম্মতভাবে অনুকরণ করতে সাহায্য করেছে।

যদিও এই গবেষণা মঙ্গলের লাল রঙের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছে, তবুও বিজ্ঞানীরা এখনও চূড়ান্ত প্রমাণের জন্য অপেক্ষা করছেন। গবেষণার অন্যতম প্রধান বিজ্ঞানী জ্যাক মাস্টার্ড বলেন, “আমরা অনুমান করতে পারছি যে ফেরিহাইড্রাইট মঙ্গলের রঙের মূল কারণ, কিন্তু এর নিশ্চিত প্রমাণ পেতে হলে আমাদের মঙ্গলের মাটির নমুনা পৃথিবীতে আনতে হবে।”

বর্তমানে নাসার পারসিভিয়ারেন্স রোভার মঙ্গলের পৃষ্ঠ থেকে বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করছে। এই নমুনাগুলো পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা করা হয়েছে, যা হলে বিজ্ঞানীরা নিশ্চিত হতে পারবেন যে মঙ্গলের লাল রঙের প্রকৃত উৎস কী।

মঙ্গল গ্রহে প্রাচীন মহাসাগরের অস্তিত্বের প্রমাণ দিয়েছেন চীনা বিজ্ঞানীরা

WhatsApp Group Join Now
Telegram Group Join Now
instagram Group Join Now

সাম্প্রতিক খবর

.আরো