মানুষের চাঁদে শেষবারের মতো পদার্পণ ছিল ১৯৭২ সালের ডিসেম্বর মাসে, নাসার অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের মাধ্যমে। এরপর দীর্ঘ ৫০ বছরেরও বেশি সময় কেটে গেছে, কিন্তু মানুষ আর চাঁদে ফিরে যায়নি। এটি কোনো প্রযুক্তিগত বা বৈজ্ঞানিক সীমাবদ্ধতার কারণে নয় বরং রাজনৈতিক ও বাজেট সম্পর্কিত জটিলতাগুলোর জন্য। এই প্রতিবন্ধকতাগুলোই মানব জাতির জন্য চাঁদে ফিরে যাওয়ার পথকে কঠিন করে তুলেছে।
চাঁদে ফিরে যাওয়ার জন্য এবং সেখানেই একটি স্থায়ী মানব ঘাঁটি স্থাপন করার অনেক কারণ আছে। অ্যাপোলো ১৭ অভিযানের পর থেকে, চাঁদের ব্যাপারে মানুষ ও বৈজ্ঞানিকদের মধ্যে একটি বিশেষ আগ্রহ জন্ম নিয়েছে। এটি পৃথিবীর নিকটবর্তী একটি জায়গা, যেখানে থাকা এবং কাজ করা সম্ভব। তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় সময়, অর্থ এবং রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রয়োজন।
সম্প্রতি, নাসার সহযোগিতায় একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি ইনটিউটিভ মেশিনস চাঁদের পৃষ্ঠে একটি নভোচারী রোবট মিশন সফলভাবে পরিচালনা করেছে। এই অবদান চাঁদে নতুন করে মানুষ পাঠানোর পথ প্রস্তুত করছে। আর্টেমিস নামে একটি নতুন মিশন ২০২৬ সালের মধ্যে চাঁদে মানুষ পাঠানোর লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছে। এই অভিযানে প্রথমবারের মতো একজন নারী, একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং একজন কানাডীয় নভোচারী চাঁদের পৃষ্ঠে পা রাখবেন।
আরও পড়ুনঃ চাঁদের অভ্যন্তরীণ গঠন নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য জানালো বিজ্ঞানীরা
চাঁদে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা একাধিক কারণে রয়েছে। একটি প্রধান কারণ হচ্ছে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির অগ্রগতি। চাঁদের উপর একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করলে তা মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। মহাকাশ গবেষণা, জ্বালানি সরবরাহ, এবং বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য চাঁদকে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়াও, এটি ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে মানব বসতি স্থাপনের জন্য একটি প্রাথমিক ধাপ হিসেবে কাজ করবে।
রাজনৈতিক ও বাজেটের প্রতিবন্ধকতা
চাঁদে পুনরায় মানুষ পাঠানোর সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে বাজেট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা। নাসার ২০২৪ সালের বাজেট ২৪.৯ বিলিয়ন ডলার, যা অনেক বড় মনে হলেও তা সংস্থার বিভিন্ন প্রকল্পের মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। যেমন জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ, স্পেস লঞ্চ সিস্টেম রকেট প্রজেক্ট, সৌরজগতের বিভিন্ন মিশন ইত্যাদি। এর সাথে তুলনা করলে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাজেট প্রায় ৮৮৩.৭ বিলিয়ন ডলার। এই পরিসংখ্যান থেকে বোঝা যায় যে, নাসার জন্য সবকিছু চালিয়ে যাওয়া কতোটা কঠিন।
১৯৬৫ সালে নাসার বাজেট ছিল মোট বাজেটের ৪%। এখন নাসার বাজেট হচ্ছে মোট বাজেটের প্রায় ০.৩৬%। ফলে পুনরায় চাঁদে ফিরে যাওয়া ও সেখানে স্থায়ীভাবে মানুষ থাকার ব্যবস্থা করা একটি বিশাল আর্থিক চ্যালেঞ্জ। আর্টেমিস মিশনের খরচ ধরা হয়েছে ২০১২ সাল থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯৩ বিলিয়ন ডলার। অ্যাপোলো মিশনের খরচ ছিল আজকের মানদণ্ডে প্রায় ২৫৭ বিলিয়ন ডলার। মানব অভিযানের খরচ অনেক বেশি, যা রাজনৈতিক সমর্থন পাওয়া খুবই কঠিন করে তুলেছে।
নাসার মিশনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক অস্থিরতা একটি বড় সমস্যা। প্রতিটি নতুন প্রশাসন এসে পূর্ববর্তী প্রশাসনের মিশনগুলো বাতিল বা পরিবর্তন করে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০০৪ সালে বুশ প্রশাসন নাসাকে চাঁদে ফেরার পরিকল্পনা করতে বলে এবং কনস্টেলেশন প্রোগ্রাম তৈরি করা হয়। কিন্তু ওবামা প্রশাসন এসে সেই প্রোগ্রাম বাতিল করে এবং নতুন রকেট প্রজেক্ট শুরু করে। এই ধরনের পরিবর্তনের ফলে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার এবং বহু বছরের সময় নষ্ট হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট বাইডেন আর্টেমিস মিশন চালিয়ে যাচ্ছেন, যা বিরল একটি উদাহরণ।
চাঁদে স্থায়ী মানব ঘাঁটির সম্ভাবনা
চাঁদে একটি স্থায়ী মানব গবেষণা স্টেশন স্থাপন করার দাবি বহু বছর ধরেই গবেষক ও উদ্যোক্তারা করে আসছেন। এটি চাঁদকে পরবর্তী গবেষণা এবং ভবিষ্যতে মঙ্গল গ্রহে যাওয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। চাঁদে একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করা হলে মহাকাশ পর্যটন, গবেষণা এবং বিভিন্ন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে তা সহায়ক হতে পারে।
চাঁদের উপর একটি স্থায়ী মানব ঘাঁটি স্থাপন করা হলে তা মহাকাশে জ্বালানি সরবরাহের কেন্দ্র হিসেবে কাজ করতে পারে, যা মঙ্গল এবং আরও দূরবর্তী স্থানে যাওয়ার জন্য সহায়ক হবে। এটি মহাকাশ পর্যটন ও বৈজ্ঞানিক গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজন হবে যথাযথ আর্থিক সহায়তা এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন।
চাঁদে স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করলে, এটি মঙ্গল এবং আরও দূরবর্তী গ্রহে অভিযানের জন্য প্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হতে পারে। চাঁদের প্রাকৃতিক সম্পদ যেমন হিলিয়াম-৩ এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ মহাকাশ গবেষণায় ব্যবহার করা যেতে পারে। এছাড়া, চাঁদে মহাকাশযানের জন্য জ্বালানি সংগ্রহ এবং প্রক্রিয়াকরণ করা সম্ভব হতে পারে, যা মঙ্গল অভিযানের খরচ কমাতে সাহায্য করবে।
পৃথিবীতে জীবনের শুরু কীভাবে হলো? বিজ্ঞানীরা এবার নতুন এক তথ্য খোঁজে পেলো
প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ
চাঁদে পুনরায় মানুষ পাঠানোর জন্য বাজেট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা ছাড়াও অনেক প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ রয়েছে। চাঁদের পৃষ্ঠে রয়েছে বড় বড় গর্ত এবং বোল্ডার, যা নিরাপদ অবতরণে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। অ্যাপোলো মিশনের পর, বিজ্ঞানীরা নভোচারীদের চাঁদের ধুলার কারণে দুই সপ্তাহ কোয়ারেন্টাইনে রেখেছিলেন। চাঁদের পৃষ্ঠে সূক্ষ্ম ধুলা রয়েছে, যা নভোচারীদের স্যুট এবং যানবাহনের সাথে লেগে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যা সৃষ্টি করে। চাঁদে দীর্ঘ মেয়াদে থাকার জন্য এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে।
চাঁদের ধুলার সমস্যা ছাড়াও, চাঁদের তাপমাত্রা নিয়েও সমস্যা রয়েছে। চাঁদের একটি পাশ প্রায় ১৪ দিনের জন্য সরাসরি সূর্যের রশ্মির মধ্যে থাকে, যেখানে তাপমাত্রা অত্যন্ত বেশি থাকে। এরপরের ১৪ দিন সেই পাশ সম্পূর্ণ অন্ধকারে থাকে এবং তাপমাত্রা মাইনাস ২০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমে যায়। নাসা বর্তমানে একটি ফিশন পাওয়ার সিস্টেম তৈরি করছে, যা নভোচারীদের বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে পারবে এবং এই তীব্র তাপমাত্রা পরিবর্তনের সময় তাদের সহায়তা করবে।
নাসা নতুন ধরনের স্পেসস্যুট এবং রোভার ডিজাইন করছে, যা চাঁদের ধুলা এবং সূর্যের রশ্মি থেকে সুরক্ষা প্রদান করবে। এগুলো চাঁদের প্রতিকূল পরিবেশে নভোচারীদের নিরাপদে থাকার জন্য সহায়ক হবে। এছাড়া, নাসা একটি নতুন ধরনের মহাকাশযান তৈরি করছে, যা চাঁদে দীর্ঘ মেয়াদে অবস্থান করতে সক্ষম হবে।
চাঁদে ফিরে যাওয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
চাঁদে ফিরে যাওয়ার জন্য বর্তমানে নাসা ছাড়াও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বড় ভূমিকা রাখছে। স্পেসএক্স, ব্লু অরিজিনের মতো কোম্পানিগুলো চাঁদে এবং মঙ্গলে যাওয়ার নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে। এই ধরনের উদ্ভাবন মহাকাশযাত্রার খরচ কমাতে এবং এটি সহজলভ্য করতে সহায়ক হবে। ইলন মাস্ক এবং জেফ বেজোসের মতো উদ্যোক্তারা মহাকাশযাত্রাকে বাণিজ্যিকভাবে সফল করতে কাজ করছেন, যা মহাকাশ গবেষণায় নতুন যুগের সূচনা করতে পারে।
স্পেসএক্স ইতোমধ্যে স্টারশিপ লঞ্চ সিস্টেমের মাধ্যমে সফলভাবে মহাকাশযাত্রার পরীক্ষা সম্পন্ন করেছে। পুনর্ব্যবহারযোগ্য রকেট তৈরি করে তারা মহাকাশযাত্রার খরচ কমানোর পথে অগ্রসর হচ্ছে। ইলন মাস্কের স্বপ্ন হচ্ছে, একদিন চাঁদ পৃথিবীর অর্থনৈতিক জগতে অন্তর্ভুক্ত হবে, যেমনটি এখন নিম্ন-পৃথিবী কক্ষপথ এবং ভূস্থির কক্ষপথে রয়েছে। এই ধরনের একটি ভবিষ্যৎ মহাকাশ গবেষণার জন্য একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
জেফ বেজোসের ব্লু অরিজিনও চাঁদে একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপনের পরিকল্পনা করছে। তিনি বিশ্বাস করেন যে, একদিন পৃথিবীর ভারী শিল্পগুলো মহাকাশে স্থানান্তরিত হবে এবং পৃথিবীকে একটি আবাসিক এবং হালকা শিল্পের জায়গা হিসেবে ব্যবহার করা হবে। এটি পরিবেশগত দিক থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে এবং মহাকাশ গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে।
আরও পড়ুনঃ ১১ বিলিয়ন বছরের মহাকাশ ইতিহাসের তত্ত্ব প্রকাশ করেছে ডিইএসআই (DESI)
মানবতার চাঁদে ফিরে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা
অনেক নভোচারী এবং মহাকাশ গবেষক বিশ্বাস করেন, চাঁদে পুনরায় মানুষের পদার্পণ শুধু সময়ের ব্যাপার। চাঁদে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে মহাকাশ গবেষণার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করা সম্ভব হবে এবং ভবিষ্যতে মঙ্গলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া যাবে। যদিও বর্তমানে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রযুক্তিগত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তবে ভবিষ্যতে এই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করা সম্ভব হবে।
চাঁদে ফিরে যাওয়া এবং সেখানে একটি স্থায়ী ঘাঁটি স্থাপন করার জন্য আমাদের প্রয়োজন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, পর্যাপ্ত বাজেট এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়ন। এটি শুধু মহাকাশ গবেষণায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে না, বরং মানব জাতির মহাকাশে নতুন বসতি স্থাপনের সম্ভাবনাও উন্মোচন করবে। মহাকাশে নতুন বসতি স্থাপনের মাধ্যমে মানব জাতি একটি নতুন যুগে প্রবেশ করবে, যেখানে পৃথিবীর বাইরেও মানুষের জীবনধারণ সম্ভব হবে।
ব্ল্যাক হোল এর তাণ্ডব: তারাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে মহাজাগতিক সংঘর্ষের সৃষ্টি