বিশ্বের প্রথম কাঠের স্যাটেলাইটের নাম লিগনোস্যাট, যা সম্প্রতি মহাকাশে পাঠানো হয়েছে। এটি কাঠের তৈরি প্রথম স্যাটেলাইট যা স্পেসএক্সের একটি রকেটের মাধ্যমে মহাকাশে প্রেরণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে জাপানের কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা এবং সুমিতোমো ফরেস্ট্রি নামক একটি কোম্পানি একত্রে কাজ করেছেন। এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের জন্য একটি বিশেষ মিশনের অংশ হিসেবে প্রেরণ করা হয়েছে, যেখানে এটি কাঠের উপাদানের স্থায়িত্ব এবং শক্তিমত্তা পরীক্ষা করা হবে। এর মাধ্যমে কাঠের উপকরণের মহাকাশে ব্যবহারযোগ্যতা নির্ধারণ করা যাবে।
লিগনোস্যাট মূলত একটি ঘনক্ষেত্র আকৃতির স্যাটেলাইট, যার প্রতিটি পাশে ১০ সেন্টিমিটার পরিমাপের। এই ছোট স্যাটেলাইটটি মহাকাশে প্রেরণ করা হয়েছে কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব স্পেসোলজি কেন্দ্র থেকে, যার প্রধান লক্ষ্য হলো কাঠের উপাদান মহাকাশের কঠিন পরিস্থিতিতে কতটা টিকে থাকতে পারে তা পরীক্ষা করা। কাঠের উপাদান সহজে পুড়ে যায় এবং এটি ধাতুর মতো বায়ুমণ্ডলে ফিরে এসে পরিবেশে ক্ষতিকারক ধাতব কণা তৈরি করে না। এই সুবিধার কারণেই কাঠকে মহাকাশে স্যাটেলাইট নির্মাণের একটি সম্ভাব্য উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
বর্তমান ধাতব স্যাটেলাইটগুলি যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে, তখন সেগুলি অনেক সময় ক্ষতিকারক ধাতব কণায় পরিণত হয়, যা পরিবেশ এবং টেলিযোগাযোগের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এই সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য কাঠের স্যাটেলাইট একটি সম্ভাব্য সমাধান হতে পারে। কিয়োটো বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা আশাবাদী যে কাঠের উপাদান বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার সময় সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যাবে এবং কোনো ক্ষতিকারক পদার্থ সৃষ্টি করবে না।
আরও পড়ুনঃ জাপানের সামরিক যোগাযোগ উপগ্রহ কিরামেকি ৩ উৎক্ষেপণ
লিগনোস্যাট স্যাটেলাইটটি নাসার কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে স্পেসএক্সের একটি বাণিজ্যিক রকেটের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। এটি জাপান অ্যারোস্পেস এক্সপ্লোরেশন এজেন্সির বিশেষভাবে প্রস্তুত করা একটি কন্টেইনারে স্থাপন করা হয়েছিল। স্যাটেলাইটটি মহাকাশে নিরাপদে পৌঁছেছে এবং কয়েক সপ্তাহের মধ্যে এটি আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (আইএসএস) থেকে মুক্তি পাবে এবং মহাকাশে প্রবেশ করবে। এতে সংযুক্ত বিভিন্ন সেন্সরের মাধ্যমে স্যাটেলাইটের কাঠামো কতটা স্থায়ী ও শক্তিশালী তা পর্যবেক্ষণ করা হবে। এছাড়াও, তাপমাত্রার চরম পরিবর্তন এবং মহাকাশের রেডিয়েশন থেকে উপকরণটি কতটা সুরক্ষিত থাকতে পারে তাও পর্যবেক্ষণ করা হবে।
লিগনোস্যাটের সহ-উন্নয়নকারী সুমিতোমো ফরেস্ট্রির একজন মুখপাত্র জানিয়েছেন যে স্যাটেলাইটটি সফলভাবে উৎক্ষেপিত হয়েছে এবং আইএসএস-এ পৌঁছানোর পর এটি মহাকাশে ছাড়া হবে। স্যাটেলাইটটির মাধ্যমে পাঠানো ডেটা গবেষকরা পরীক্ষা করবেন এবং কাঠের উপাদান মহাকাশের চরম পরিবেশে কতটা কার্যকর তা যাচাই করবেন।
ধাতব স্যাটেলাইটের বিকল্প হিসেবে কাঠের স্যাটেলাইট তৈরির পেছনে মূলত কিছু পরিবেশগত এবং টেকসই কারণ রয়েছে। ধাতু মহাকাশে প্রেরণ করা এবং তা প্রক্রিয়াকরণ বেশ ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। এর পরিবর্তে কাঠ একটি নবায়নযোগ্য উপাদান যা সহজেই উৎপাদনযোগ্য এবং পরিবেশ বান্ধব। লিগনোস্যাটের সহ-উন্নয়নকারী এবং জাপানের মহাকাশচারী তাকাও দোই মনে করেন, কাঠের উপাদান মহাকাশে টেকসই এবং স্থায়ী স্যাটেলাইট নির্মাণের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে প্রধান উপাদান হিসেবে গৃহীত হতে পারে।
লিগনোস্যাটে ব্যবহৃত কাঠের প্যানেলগুলো ম্যাগনোলিয়া গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি, এবং এগুলো তৈরি করার সময় কোনো ধরনের স্ক্রু বা আঠা ব্যবহার করা হয়নি। গবেষকরা ধারণা করছেন যে ভবিষ্যতে কাঠের উপাদান মহাকাশ গবেষণা এবং নির্মাণের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। কাঠ মহাকাশে অন্যান্য গ্রহে বাসস্থান নির্মাণ বা অন্যান্য উপাদান তৈরি করতেও ব্যবহার হতে পারে, যেহেতু এটি সহজেই উৎপাদন করা যায় এবং পরিবেশবান্ধব। মহাকাশে মানুষের টিকে থাকার জন্য কাঠ একটি নতুন সম্ভাবনা হতে পারে।
লিগনোস্যাট প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য হলো মহাকাশে কাঠের উপাদান কতটা কার্যকর তা পরীক্ষা করা। কাঠ ধাতব উপকরণের তুলনায় অনেক কম তাপমাত্রা সহনশীল হলেও এটি পরিবেশবান্ধব এবং সহজেই প্রক্রিয়াকরণযোগ্য। মহাকাশে অতিরিক্ত ধাতব স্যাটেলাইট প্রেরণ করার ফলে পরিবেশের ক্ষতি হয়, এবং মহাকাশে বর্জ্য তৈরি হয়। কাঠের স্যাটেলাইট ব্যবহার করে এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হতে পারে।
আরও পড়ুনঃ আন্তর্জাতিক স্পেস স্টেশন থেকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরেছেন ৮ জন ক্রু
এছাড়াও, মহাকাশে দীর্ঘস্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য কাঠের ব্যবহার নিয়ে গবেষণা করা হচ্ছে। কাঠের তৈরি বস্তু মহাকাশে ব্যবহার করা গেলে, এটি মহাকাশ গবেষণার খরচ কমাবে এবং গবেষকরা সহজেই মহাকাশে কাঠের ব্যবহারযোগ্যতা সম্পর্কে ধারণা পেতে পারবেন। মহাকাশ গবেষণার ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য কাঠ একটি সম্ভাবনাময় উপাদান হতে পারে।
লিগনোস্যাট প্রকল্পটি বিশ্বের প্রথম কাঠের স্যাটেলাইট এবং এটি মহাকাশে টেকসই উপকরণ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি বড় পদক্ষেপ। কাঠের উপাদান সহজেই পুড়ে যায় এবং কোনো ক্ষতিকারক পদার্থ তৈরি করে না, যা পরিবেশ বান্ধব এবং মহাকাশে বর্জ্য কমাতে সহায়ক। ভবিষ্যতে কাঠের স্যাটেলাইট মহাকাশ গবেষণা এবং মহাকাশে মানুষের টিকে থাকার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।